দেশের সাধারণ ভোক্তা থেকে শুরু করে পরিবেশক, গ্যাসচালিত যানবাহন মালিক, হোটেল–রেস্তোরাঁর ব্যবসায়ী—সবার নজর এখন ডিসেম্বর মাসের এলপি গ্যাসের নতুন দামের দিকে। ডিসেম্বরের বাজারে এলপি গ্যাসের দাম বাড়বে কি কমবে—এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে আগামী মঙ্গলবার (২ ডিসেম্বর)। ওই দিনই বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) মাসিক মূল্য সমন্বয়ের ভিত্তিতে নতুন দাম ঘোষণা করবে।
বিইআরসি সোমবার (১ ডিসেম্বর) এক সরকারি বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, আন্তর্জাতিক বাজারে সৌদি আরামকো প্রকাশিত ডিসেম্বরের সৌদি সিপি (Contract Price)–এর ভিত্তিতে দেশে বেসরকারি এলপি গ্যাসের ভোক্তা পর্যায়ের দাম নির্ধারণ করা হবে।
বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, মঙ্গলবার বিকেল ৩টায় রাজধানীর ইনস্টিটিউশন অব ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইইবি) এর শহীদ প্রকৌশলী ভবনে সংবাদ সম্মেলনে এ দাম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করবে কমিশন।
কেন প্রতি মাসে বদলায় এলপি গ্যাসের দাম?
বাংলাদেশে বেসরকারি খাতে বিক্রি হওয়া এলপি গ্যাস সম্পূর্ণভাবে আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীল। আন্তর্জাতিক বাজারে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের দাম নির্ধারণে ‘সৌদি সিপি’ বিশ্বব্যাপী মানদণ্ড হিসেবে ব্যবহৃত হয়।
এখন আর দেশে এলপি গ্যাসের এককালীন দাম নির্ধারণ করা হয় না—বরং প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক মূল্য পরিবর্তনের সঙ্গে মিল রেখেই দাম সমন্বয় করা হয়।
বিইআরসি ২০২১ সাল থেকে একটি নির্দিষ্ট ফর্মুলা অনুসরণ করে প্রতিমাসে দাম নির্ধারণ করছে। এর ফলে ভোক্তারা একদিকে স্বচ্ছ মূল্য জানতে পারছেন, অন্যদিকে নতুন দাম নিয়ে আগাম আলোচনাও শুরু হয়ে যায়।
গত মাসে কী হয়েছিল?
সবশেষ গত ২ নভেম্বর বিইআরসি এলপি গ্যাসের দাম কমিয়েছিল। সেই সময়
- ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ২৬ টাকা কমিয়ে ১,২৪১ টাকা থেকে কমিয়ে ১,২১৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়।
- একই দিনে অটোগ্যাসের দাম লিটারপ্রতি ১ টাকা ১৯ পয়সা কমানো হয়।
এর ফলে ভ্যাটসহ প্রতি লিটার অটোগ্যাসের দাম দাঁড়ায় ৫৫ টাকা ৫৮ পয়সা।
এ কারণে নভেম্বর মাসজুড়ে ভোক্তারা কিছুটা স্বস্তিতে ছিলেন। তবে ডিসেম্বরেও কি দাম কমবে, নাকি আবার বাড়বে—সেই অনিশ্চয়তা থেকেই যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক বাজারে কী পরিস্থিতি: বাড়ছে না কমছে?
এলপি গ্যাসের দাম নির্ধারণে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো আন্তর্জাতিক বাজারের প্রবণতা।
সাম্প্রতিক সময়ে এলপি গ্যাসের বিশ্ববাজার কয়েকটি কারণে অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে—
১. মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা
মধ্যপ্রাচ্য বিশ্বব্যাপী এলপিজির সবচেয়ে বড় উৎস। অঞ্চলে উত্তেজনা বাড়লে জ্বালানি আর্দশের মূল্য ওঠানামা স্বাভাবিকভাবেই হয়। ডিসেম্বরের সিপি ঘোষণার আগে বাজারে অস্থিরতা দেখা গেছে।
২. বৈশ্বিক শীত মৌসুমের চাহিদা বৃদ্ধি
শীতকালে গরম রাখার জন্য বিশ্বজুড়ে এলপি গ্যাসের ব্যবহার বাড়ে। চাহিদা বেড়ে গেলে দাম বাড়ার প্রবণতা থাকে।
৩. মুদ্রাবাজারের ওঠানামা
টাকা–ডলারের বিনিময় হার বাড়লে আমদানির খরচও বাড়ে। বাংলাদেশে সাম্প্রতিক মুদ্রাবাজার কিছুটা স্থির হলেও আমদানিকারকরা বলছেন, অস্থিরতার প্রভাব এখনও রয়ে গেছে।
এগুলোর প্রভাব মিলিয়েই বিইআরসি দেশের ভোক্তা পর্যায়ের দাম নির্ধারণ করবে।
বিইআরসি কীভাবে দাম নির্ধারণ করে?
বিইআরসি যে ফর্মুলা অনুসরণ করে, তাতে আন্তর্জাতিক বাজারের দাম ছাড়াও বিবেচনায় নেওয়া হয়—
- আমদানি খরচ
- পরিবহন ব্যয়
- মুদ্রা বিনিময় হার
- বোতলজাতকরণ ব্যয়
- পরিবেশক কমিশন
- ব্যবসায়ীদের নির্ধারিত মার্জিন
এসবই যুক্ত হয়ে শেষ পর্যন্ত একটি সিলিন্ডার ভোক্তা বিক্রয়মূল্যে পৌঁছায়।
ভোক্তারা কী আশা করছেন?
দেশের অধিকাংশ পরিবার এখন রান্নার জন্য এলপি গ্যাসের ওপর নির্ভরশীল। বিশেষ করে শহর ও শহরতলীতে এটি একমাত্র বিকল্প। ফলে সিলিন্ডারের দাম বাড়লে তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় সরাসরি বৃদ্ধির মুখে পড়ে।
ভোক্তা পর্যায়ে জরিপ করলে দেখা যায়—
- সাম্প্রতিক কয়েক বছরে একাধিকবার লাফিয়ে লাফিয়ে দাম বাড়ায় ভোক্তারা উদ্বিগ্ন।
- অপরদিকে, ব্যবসায়ীরা আশা করছেন আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল থাকলে দাম কমানোর সুযোগ থাকতে পারে।
তবে দাম বাড়ুক বা কমুক—প্রত্যাশা একটাই: স্থিতিশীলতা।
অটোগ্যাস বাজারের অবস্থাও গুরুত্বপূর্ণ
বাংলাদেশে সিএনজি-চালিত গাড়ির পাশাপাশি অটোগ্যাসচালিত যানবাহনের সংখ্যা বাড়ছে।
বর্তমানে–
- ব্যক্তিগত গাড়ি,
- রাইডশেয়ারিং,
- লোকাল পরিবহন
— সবখানেই অটোগ্যাস ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে।
নভেম্বর মাসে দাম কমায় অটোগ্যাস ব্যবহারকারীরা কিছুটা স্বস্তি পেয়েছিল। ডিসেম্বরের দাম আবার বাড়লে পরিবহন ব্যয় বাড়তে পারে, যা ভাড়া বৃদ্ধির চাপও তৈরি করতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা কী বলছেন?
জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞদের মতে—
১. দাম কমার সম্ভাবনা কম, স্থিতিশীল থাকার সম্ভাবনা বেশি
কারণ আন্তর্জাতিক বাজারে সিপি খুব বেশি কমেনি। ফলে বাংলাদেশে মূল্য পরিবর্তন খুব বেশি হওয়ার সম্ভাবনা নেই।
২. মুদ্রাবাজার স্থিতিশীল হলেও আমদানি ব্যয় কমেনি
ডলারের দাম কমলেও পরিবহন ও শিপিং খরচ বেড়েছে। ফলে দাম কমাতে বাধা তৈরি হতে পারে।
৩. পরিবেশবান্ধব জ্বালানিতে আগ্রহ বাড়ছে
যদি দাম খুব বেশি বাড়ে তবে ভোক্তারা বিকল্প জ্বালানির দিকে ঝুঁকতে পারেন। এই বিষয়টিও বিবেচনায় রাখা উচিত।
পরিবেশক ও ব্যবসায়ীরা কী বলছেন?
দেশের মোট এলপি গ্যাসের বাজারের ৯০ শতাংশের বেশি নিয়ন্ত্রণ করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। ব্যবসায়ীরা বলছেন—
- আমদানির সব খরচ আন্তর্জাতিক বাজারনির্ভর।
- আন্তর্জাতিক বাজার স্থিতিশীল না থাকায় স্থানীয় দাম সমন্বয় বাধ্যতামূলক হয়ে পড়ে।
- বারবার দাম পরিবর্তন ভোক্তার আস্থা কমায়। তাই মূল্য সমন্বয় প্রক্রিয়া আরও স্থিতিশীল হওয়া উচিত।
এদিকে পরিবেশকরা বলছেন, ভোক্তাদের কাছে দাম পৌঁছাতে তাদের যন্ত্রাংশ, পরিবহন ও শ্রম ব্যয়ও বাড়ছে, যা সঠিকভাবে বিবেচনায় নেওয়া প্রয়োজন।
সাড়ে তিন কোটি মানুষ এলপি গ্যাস ব্যবহার করে
যদিও আগে বাংলাদেশে পাইপলাইনের গ্যাসব্যবস্থা শহরকেন্দ্রিক ছিল, বর্তমানে এলপি গ্যাস দেশের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত গৃহস্থালি জ্বালানি।
অন্যদিকে—
- রেস্তোরাঁ,
- ক্ষুদ্র ব্যবসা,
- শিল্পকারখানা,
— এসব ক্ষেত্রেও এর ব্যবহার দ্রুত বাড়ছে।
বাংলাদেশে এখন বছরে ১৫–১৭ লাখ টন এলপি গ্যাস ব্যবহৃত হয়, যার ৯৮ শতাংশই আমদানি করতে হয়।
মঙ্গলবারের ঘোষণায় কী থাকতে পারে?
সাধারণত বিইআরসি নিম্নোক্ত তথ্য জানায়—
- নতুন সিপি অনুযায়ী দাম বাড়ল না কমল
- ১২ কেজি, ১৫ কেজি, ১৮ কেজি, ২৫ কেজি ও ৪৫ কেজি সিলিন্ডারের সংশোধিত দাম
- অটোগ্যাসের নতুন লিটারপ্রতি মূল্য
- মূল্য কার্যকর হওয়ার সময়
- এবং আন্তর্জাতিক বাজারের ব্যাখ্যা
ভোক্তা, পরিবেশক, ব্যবসায়ী—সবাই মঙ্গলবারের দাম ঘোষণার অপেক্ষায়।
দাম বাড়লে প্রভাব পড়বে ঘরোয়া রান্না থেকে শুরু করে পরিবহন খরচ পর্যন্ত।
দাম কমলে কিছুটা স্বস্তি মিলবে বাজারে।
যাই হোক, ডিসেম্বর মাসের এলপি গ্যাসের মূল্য ঘোষণা বাংলাদেশের জ্বালানি বাজারে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলতে যাচ্ছে—এ নিয়ে আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে বিইআরসি’র মঙ্গলবারের সংবাদ সম্মেলন।
MAH – 14086 I Signalbd.com



