অর্থনীতি

নভেম্বরের ২৩ দিনে এলো ২২৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স

Advertisement

চলতি নভেম্বর মাসের প্রথম ২৩ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২২৭ কোটি ১০ লাখ মার্কিন ডলার। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, এই সময়ে প্রতিদিন গড়ে দেশে এসেছে প্রায় ৯ কোটি ৮৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। গত বছরের একই সময়ের তুলনায় এই রেমিট্যান্স প্রবাহে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি লক্ষ্য করা গেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের স্বস্তি এনেছে।

সোমবার (২৪ নভেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র শাহরিয়ার সিদ্দিকী এই তথ্য নিশ্চিত করেছেন। তিনি জানান, গত বছরের নভেম্বরের প্রথম ২৩ দিনে রেমিট্যান্স এসেছিল মাত্র ১৭২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ ৩২ শতাংশেরও বেশি বেড়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিদের পাঠানো এই অর্থ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করতে এবং ডলারের সংকট মোকাবিলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

সাম্প্রতিক রেমিট্যান্সের পরিসংখ্যান ও প্রবৃদ্ধির চিত্র

নভেম্বরের ২৩ দিনের রেমিট্যান্স প্রবাহ বিশ্লেষণ করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য তুলে ধরেছে।

গড় রেমিট্যান্স প্রবাহ: নভেম্বর মাসের প্রথম ২৩ দিনে মোট রেমিট্যান্স এসেছে ২২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। এই হিসাবে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৯ কোটি ৮৭ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে এসেছে। রেমিট্যান্স প্রবাহে এই গতিশীলতা বজায় থাকলে মাস শেষে রেমিট্যান্সের পরিমাণ গত মাসের তুলনায় বাড়তে পারে।

একদিনের রেকর্ড: শুধুমাত্র গত ২৩ নভেম্বর একদিনেই প্রবাসীরা দেশে পাঠিয়েছেন ১৩ কোটি ৬০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। এই একদিনের প্রবাহ রেমিট্যান্সের উচ্চ প্রবৃদ্ধির ইঙ্গিত দেয়।

তুলনামূলক প্রবৃদ্ধি: কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যমতে, গত বছরের নভেম্বরের প্রথম ২৩ দিনে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৭২ কোটি ৬০ লাখ ডলার। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে প্রায় ৫৪ কোটি ৫০ লাখ ডলার, যা প্রায় ৩১ দশমিক ৫৫ শতাংশ প্রবৃদ্ধি। এই প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য অত্যন্ত ইতিবাচক।

চলতি অর্থবছরের (জুলাই-নভেম্বর) সামগ্রিক অবস্থা

চলতি ২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের রেমিট্যান্স প্রবাহ বেশ শক্তিশালী অবস্থানে রয়েছে।

মোট প্রবাহ: চলতি অর্থবছরের জুলাই থেকে ২৩ নভেম্বর পর্যন্ত দেশে মোট রেমিট্যান্স দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ২৪২ কোটি ডলার

বার্ষিক প্রবৃদ্ধি: গত বছরের একই সময়ের তুলনায় চলতি অর্থবছরের এই পর্যন্ত রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়েছে ১৬ দশমিক ৫০ শতাংশ। এই শক্তিশালী প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে চলতি অর্থবছরের শেষে রেমিট্যান্স প্রবাহ নতুন রেকর্ড গড়তে পারে।

মাসভিত্তিক প্রবাহের প্রবণতা: এর আগে গত অক্টোবর মাসে দেশে এসেছিল ২৫৬ কোটি ৩৪ লাখ ৮০ হাজার ডলার এবং সেপ্টেম্বরে এসেছিল ২৬৮ কোটি ৫৮ লাখ ৮০ হাজার মার্কিন ডলার। আগস্ট ও জুলাইয়ে যথাক্রমে দেশে এসেছিল ২৪২ কোটি ১৮ লাখ ৯০ হাজার ও ২৪৭ কোটি ৮০ লাখ ডলার রেমিট্যান্স। এই তথ্য প্রমাণ করে, রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রায় প্রতি মাসেই ২০০ কোটি ডলারের উপরে থাকছে।

রেমিট্যান্স বৃদ্ধির কারণ ও অর্থনীতিতে প্রভাব

প্রবাসী আয়ে এই উল্লম্ফন বেশ কিছু আর্থ-সামাজিক কারণ এবং সরকারের নীতিমালার ফল।

বিনিময় হার সুবিধা: রেমিট্যান্স বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ হলো হুন্ডি বা অবৈধ পথে টাকা পাঠানো বন্ধ করে ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠাতে উৎসাহিত করা। ব্যাংকিং চ্যানেলে ডলারের বিনিময় হার এখন খোলাবাজারের কাছাকাছি বা কখনো কখনো বেশি হওয়ায় প্রবাসীরা বৈধ পথে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন।

উৎসব ও প্রণোদনা: সামনে বিশেষ কোনো উৎসব বা সরকারি প্রণোদনা (যেমন ২.৫ শতাংশ হারে প্রণোদনা) রেমিট্যান্স প্রবাহকে প্রভাবিত করে থাকতে পারে। উৎসবের আগে সাধারণত প্রবাসীরা বেশি পরিমাণে অর্থ দেশে পাঠান।

ডলারের চাহিদা ও সংকট: দেশের বাজারে ডলারের তীব্র সংকট চলছে। বৈধ পথে রেমিট্যান্সের এই প্রবাহ ডলারের জোগান বাড়াতে এবং আন্তঃব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের চাপ সামলাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। রেমিট্যান্স বৃদ্ধি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের উপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

অর্থনীতিবিদদের বিশ্লেষণ ও সরকারের ভূমিকা

অর্থনীতিবিদরা রেমিট্যান্সের এই প্রবৃদ্ধিকে দেশের অর্থনীতির জন্য ‘স্বস্তির নিঃশ্বাস’ হিসেবে দেখছেন।

রিজার্ভের শক্তিশালীকরণ: অর্থনীতিবিদরা বলছেন, এই রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভকে শক্তিশালী করবে এবং সরকারের আমদানি বিল পরিশোধের ক্ষমতা বাড়াবে। রেমিট্যান্স বাংলাদেশের মতো আমদানি নির্ভর অর্থনীতির জন্য রক্ত সঞ্চালনের মতো কাজ করে।

সরকারের ভূমিকা: বাংলাদেশ ব্যাংক রেমিট্যান্স প্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে অবৈধ হুন্ডি বাণিজ্যের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিয়েছে। এই পদক্ষেপের কারণে হুন্ডি কমে যাওয়ায় বৈধ পথে রেমিট্যান্স বেড়েছে। এছাড়া ২.৫ শতাংশ সরকারি প্রণোদনাও প্রবাসীদের উৎসাহিত করছে।

দীর্ঘমেয়াদী চ্যালেঞ্জ: অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে বলেছেন, এই প্রবৃদ্ধি যেন স্বল্পমেয়াদী না হয়। দীর্ঘমেয়াদে রেমিট্যান্স প্রবাহ ধরে রাখতে হলে প্রবাসী কর্মীদের জন্য বিনিয়োগের সুযোগ তৈরি করা এবং বিদেশে নতুন শ্রমবাজার খুঁজে বের করার উপর জোর দিতে হবে।

শাহরিয়ার সিদ্দিকী, বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র (কোট): “নভেম্বরের প্রথম ২৩ দিনে দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ২২৭ কোটি ১০ লাখ ডলার। বছর ব্যবধানে রেমিট্যান্স প্রবাহ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে, যা দেশের অর্থনীতিতে অত্যন্ত ইতিবাচক একটি দিক।”

পূর্ববর্তী অর্থবছরের রেকর্ড ও ভবিষ্যতের প্রত্যাশা

সাম্প্রতিক রেমিট্যান্স প্রবাহ গত অর্থবছরের রেকর্ডকে ছাড়িয়ে যাওয়ার প্রত্যাশা তৈরি করছে।

গত অর্থবছরের রেকর্ড: গত ২০২৪-২৫ অর্থবছর জুড়ে দেশে প্রবাসীরা পাঠিয়েছিলেন ৩০ দশমিক ৩২ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৩২ কোটি ৮০ লাখ মার্কিন ডলার রেমিট্যান্স। এটি দেশের ইতিহাসে কোনো নির্দিষ্ট অর্থবছরে সর্বোচ্চ প্রবাসী আয়ের রেকর্ড।

ভবিষ্যতের প্রত্যাশা: চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসের শক্তিশালী প্রবাহের কারণে বিশেষজ্ঞরা আশা করছেন, এই বছর রেমিট্যান্স প্রবাহ নতুন রেকর্ড স্থাপন করতে পারে, যা ৩০ বিলিয়ন ডলারের মাইলফলক অতিক্রমের সম্ভাবনা রাখে।

প্রবাসী কর্মীর সংখ্যা: বিদেশে নতুন শ্রমবাজার তৈরি হওয়ায় এবং আগের কর্মীদের স্থিতিশীল কর্মসংস্থানের কারণে প্রবাসী কর্মীদের পাঠানো অর্থের পরিমাণ ও সংখ্যা দুটোই বাড়ছে। জনশক্তি রপ্তানি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে রেমিট্যান্সের পরিমাণ বাড়বে।

প্রবাসীদের ভূমিকায় দেশের অর্থনীতির চাকা সচল

নভেম্বর মাসের ২৩ দিনে ২২৭ কোটি ডলার রেমিট্যান্স আসার তথ্য দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি বড় ইতিবাচক দিক। এই শক্তিশালী প্রবৃদ্ধি প্রমাণ করে যে, ডলার সংকটের এই সময়ে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে প্রবাসী বাংলাদেশিরাই প্রধান ভূমিকা পালন করছেন। বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক হুন্ডি রোধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ এবং সরকারি প্রণোদনার ফলে বৈধ পথে টাকা পাঠানোর প্রবণতা বাড়ায় এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উচিত, এই ইতিবাচক ধারা বজায় রাখতে বিনিময় হারকে বাজারের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখা এবং প্রবাসী কর্মীদের জন্য আরও সুযোগ তৈরি করা। রেমিট্যান্স প্রবাহের এই ঊর্ধ্বগতি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের চাপ কমিয়ে আনবে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের লড়াইয়ে সরকারকে আরও শক্তি যোগাবে।

এম আর এম – ২৩৬০,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button