বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ দীর্ঘদিন ধরেই বাড়ছে। বাজারমুখী সুদহার চালু হওয়ার পর বেশ কয়েকটি ব্যাংকে আমানত উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে। কিন্তু আমানত বৃদ্ধির বিপরীতে সেই অনুপাতে বিনিয়োগ বাড়তে না পারায় ব্যাংকিং সিস্টেমে বড় অঙ্কের অর্থ অলস অবস্থায় পড়ে আছে। ফলে পুরো ব্যাংকিং খাত এখন অতিরিক্ত তারল্য ব্যবস্থাপনার কঠিন বাস্তবতার মুখোমুখি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনে দেখা যায়, চলতি বছরের আগস্ট শেষে ব্যাংকিং খাতে অতিরিক্ত তারল্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে তিন লাখ ছয় হাজার ১১২ কোটি টাকা। যা গত বছরের একই সময়ে ছিল এক লাখ ৭৪ হাজার ৫৬৭ কোটি টাকা। অর্থাৎ মাত্র এক বছরের ব্যবধানে অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে এক লাখ ৩১ হাজার ৫৪৫ কোটি টাকা—যা অর্থনীতির জন্য গুরুত্বপূর্ণ বার্তা বহন করে।
সুদহার বাজারমুখী হওয়ায় আমানত বৃদ্ধি
কয়েক বছর আগে পর্যন্ত ব্যাংক ঋণের সুদহার একটি নির্দিষ্ট মাত্রায় আটকে রাখা ছিল। সুদহার বাজারচালিত হওয়ার পর আমানতের সুদহার বিভিন্ন ব্যাংকে বেড়ে যায়। এতে স্বাভাবিকভাবেই গ্রাহকেরা ভালো সুদ পাওয়ার আশায় সেসব ব্যাংকে সঞ্চয় রাখছেন।
গত এক বছরে ভালো অবস্থার ব্যাংকগুলোতে আমানতের প্রবাহ বেড়েছে। তবে আমানত বৃদ্ধির বিপরীতে বিনিয়োগ বাড়েনি। ব্যাংকের কাছে টাকা জমা হলে তা থেকে ঋণ দেওয়া ও বিভিন্ন বিনিয়োগে অর্থ প্রবাহিত হওয়ার কথা। কিন্তু চলমান রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা, উচ্চ সুদহার, ব্যবসায়িক পরিবেশের অনিশ্চয়তা এবং ঋণ খেলাপির ঝুঁকি বৃদ্ধির কারণে অনেক ব্যাংক মূল্যায়নে আরও সতর্ক হয়ে গেছে।
ফলে আমানত হাতছানি দিয়ে থাকলেও বিনিয়োগে গতি আসছে না।
ব্যাংক খাতে তারল্য প্রয়োজন ও অতিরিক্ত অর্থের হিসাব
বাংলাদেশ ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, প্রতিটি ব্যাংককে তাদের মোট আমানতের একটি অংশ সিআরআর (ক্যাশ রিজার্ভ রেশিও) এবং এসএলআর (স্ট্যাটুটরি লিকুইডিটি রেশিও) হিসেবে রাখতে হয়। সিআরআর নগদ আকারে এবং এসএলআর সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডে রাখতে হয়। এসব বাধ্যতামূলক সংরক্ষণ বাদ দিলেই হিসাব করা হয় অতিরিক্ত বা উদ্বৃত্ত তারল্য।
২০২৫ সালের আগস্টে ব্যাংকিং খাতে তারল্য রাখার প্রয়োজন ছিল দুই লাখ ২৬ হাজার ৭০২ কোটি টাকা। কিন্তু মোট তারল্য দাঁড়ায় পাঁচ লাখ ৩২ হাজার ৮১৪ কোটি টাকায়। অর্থাৎ প্রয়োজনের তুলনায় যে অংশ বাড়তি পাওয়া গেছে সেটিই অতিরিক্ত তারল্য।
এখন সেই অংশই দাঁড়িয়েছে তিন লাখ কোটি টাকারও বেশি।
কোন ধরনের ব্যাংকে কত তারল্য
রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক
রাষ্ট্রায়ত্ত ছয় ব্যাংকে আগস্ট শেষে অতিরিক্ত তারল্য ছিল এক লাখ ৪৩ কোটি টাকা।
রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোতে আমানত বৃদ্ধির পাশাপাশি বিনিয়োগ ঝুঁকি বেশি হওয়ায় তাদের মধ্যে অনেকেই নতুন ঋণ প্রদানে সতর্ক অবস্থায় রয়েছে। ফলে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকগুলোর উদ্বৃত্ত তারল্য বাড়ছে।
বেসরকারি ব্যাংক
বেসরকারি ৪৩ ব্যাংকের অতিরিক্ত তারল্য দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৭৩ হাজার ৯৫১ কোটি টাকা।
গবেষকদের মতে, ভালো ব্যবস্থাপনা ও সেবার কারণে জনগণের আস্থা বেসরকারি ব্যাংকে বাড়ছে। এর ফলে খাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ সঞ্চয় জমা হলেও বিনিয়োগে মন্দাভাব রয়ে গেছে।
বিদেশি ব্যাংক
বিদেশি ৯ ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য ৩২ হাজার ১১৮ কোটি টাকা।
বিদেশি ব্যাংকগুলো সাধারণত বড় শিল্প ঋণ কম দেয় এবং করপোরেট লেনদেনে বেশি গুরুত্ব দেয়। বাজার অস্থির থাকায় তারাও নতুন অর্থ ছাড়ে সতর্ক।
অতিরিক্ত তারল্যের শীর্ষ ব্যাংকগুলো
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, আগস্ট শেষে সবচেয়ে বেশি অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে সোনালী ব্যাংকে—৬২ হাজার ৩২২ কোটি টাকা।
তারপর পর্যায়ক্রমে:
- ব্র্যাক ব্যাংক: ১৮ হাজার ৮৭৭ কোটি টাকা
- পূবালী ব্যাংক: ১৮ হাজার ৩৯৮ কোটি টাকা
- অগ্রণী ব্যাংক: ১৮ হাজার ৩৫১ কোটি টাকা
- ব্যাংক এশিয়া: ১৭ হাজার ৯০৫ কোটি টাকা
এ ছাড়া আরও কয়েকটি ব্যাংকে উল্লেখযোগ্য অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে:
- ডাচ-বাংলা ব্যাংক: ১৬ হাজার ২২০ কোটি টাকা
- যমুনা ব্যাংক: ১৪ হাজার ৮০১ কোটি টাকা
- রূপালী ব্যাংক: ১২ হাজার ৫৫৩ কোটি টাকা
- সিটি ব্যাংক: ১২ হাজার ৪৮১ কোটি টাকা
- স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক: ১২ হাজার ৩৫৯ কোটি টাকা
এ তালিকা স্পষ্ট করে যে দেশের বড় ব্যাংকেই অতিরিক্ত অর্থ সবচেয়ে বেশি আটকে রয়েছে।
বেসরকারি খাতে ঋণ কমছে কেন
আগস্ট পর্যন্ত বেসরকারি খাতে ঋণ প্রবৃদ্ধি দাঁড়িয়েছে মাত্র ৬ দশমিক ৩৫ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে তা আরও কমে হয় ৬ দশমিক ২৯ শতাংশ।
এই প্রবৃদ্ধি বিগত কয়েক বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন।
প্রধান কারণগুলো হলো:
- উচ্চ সুদহার: ঋণ নেওয়া ব্যবসার জন্য ব্যয়বহুল হয়ে উঠেছে।
- বিনিয়োগে অনিশ্চয়তা: রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থির, নির্বাচন–পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনর্গঠন চলছে।
- ব্যাংকের সতর্কতা: ঋণ খেলাপির ঝুঁকি বাড়ায় নতুন ঋণ দেওয়ার আগে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত যাচাই করছে।
- সরকারি ঋণ কমে যাওয়া: সরকার আগের তুলনায় কম ঋণ নিচ্ছে, ফলে ব্যাংকের কাছে অর্থ জমে থাকছে।
এসব কারণ একত্রে বিনিয়োগ ও উৎপাদন খাতে নতুন অর্থ প্রবাহ কমিয়ে দিয়েছে। এর প্রভাবে বাড়ছে তারল্য সংকট—যা একদিকে ব্যাংকের জন্য খরচ বাড়ায়, অন্যদিকে অর্থনীতির প্রবাহ কমিয়ে দেয়।
অতিরিক্ত তারল্য–ভালো না খারাপ?
বিশেষজ্ঞদের মতে, একটি ব্যাংকে কিছু পরিমাণ উদ্বৃত্ত তারল্য থাকা ভালো। এতে হঠাৎ আমানত উত্তোলন বা বাজার অস্থিরতার ধাক্কা সামলানো যায়।
কিন্তু পরিস্থিতি যখন এমন দাঁড়ায় যে—
- বিনিয়োগ কমে যায়,
- উৎপাদন ও শিল্পায়নে অর্থ প্রবাহ হ্রাস পায়,
- ব্যাংকগুলো বড় অঙ্কের টাকা অলসভাবে ধরে রাখে—
তখন অতিরিক্ত তারল্য অর্থনীতির জন্য নেতিবাচক সংকেত হয়ে দাঁড়ায়।
এটি দেখায় অর্থনীতির গতি মন্থর, ব্যবসায়ীরা নতুন প্রকল্পে ঝুঁকি নিতে আগ্রহী নন এবং ব্যাংকিং খাত পর্যাপ্ত ঋণ দিতে পারছে না।
সামগ্রিকভাবে অর্থনীতির জন্য বার্তা কী
বাংলাদেশের অর্থনীতি বর্তমানে যে পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, সেখানে ব্যাংকিং খাতের এই তারল্য বৃদ্ধির কয়েকটি স্পষ্ট বার্তা পাওয়া যায়:
- বিনিয়োগ মন্থর হয়ে গেছে।
- ব্যবসায়ীরা অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
- ঋণখেলাপি সমস্যা সমাধান না হওয়ায় ব্যাংকগুলো ঝুঁকি নিতে চায় না।
- অভ্যন্তরীণ বাজারে আস্থা কমে গেছে।
- অর্থনৈতিক নীতিমালায় স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার প্রয়োজন।
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, অতিরিক্ত তারল্য তখনই কমবে যখন—
- শিল্প-বাণিজ্যে নতুন ঋণ প্রবাহ বাড়বে,
- উৎপাদন ও বিনিয়োগের গতি বাড়বে,
- আর্থিক খাতে আস্থা ফিরবে।
অন্যথায় বৃহৎ এই তারল্য ব্যাংকের জন্য বোঝা হয়ে থাকবে।
সমাধান কোথায়
বিশ্লেষকেরা মনে করেন, এই পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে কয়েকটি উদ্যোগ জরুরি:
১. বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি
নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলোকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, কর কাঠামো সহজীকরণ এবং ব্যবসার খরচ কমাতে সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে।
২. ঋণ পুনঃতফসিল ও খেলাপি নিয়ন্ত্রণ
অকার্যকর ঋণ কমানো না গেলে ব্যাংকগুলো কখনোই স্বাভাবিক গতিতে ঋণ দিতে পারবে না।
৩. সুদের হার স্থিতিশীল রাখা
অতিরিক্ত ওঠানামা ব্যবসায়ীদের নিরুৎসাহিত করে।
৪. দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্পে অর্থায়ন উৎসাহিত করা
শিল্প ও অবকাঠামো খাতে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দিলে তারল্য কমবে এবং উৎপাদন বাড়বে।
৫. সরকারের প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহণ বাড়ানো
যদি বন্ড বা টিবিলের মাধ্যমে সরকারের ঋণ গ্রহণ বাড়ে, ব্যাংকগুলোর অতিরিক্ত তারল্য কিছুটা হলেও কমবে।
ব্যাংকিং খাতে তিন লাখ কোটি টাকার অতিরিক্ত তারল্য শুধুই একটি সংখ্যা নয়—এটি বর্তমান অর্থনীতির সার্বিক গতি, ব্যবসার আস্থা, বিনিয়োগের গতি এবং ঋণ প্রবাহের একটি স্পষ্ট প্রতিচ্ছবি।
অর্থনীতি সচল রাখতে ব্যাংক–ঋণ–বিনিয়োগ—এই তিনটির মধ্যে সম্পর্ক অপরিহার্য। কিন্তু যখন একদিকে আমানত বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে ঋণ কমে—তখন ব্যাংক খাত ভারসাম্য হারায়। আর সেই ভারসাম্যহীনতারই প্রতিফলন এই বিশাল পরিমাণ অতিরিক্ত তারল্য।
এটি মোকাবিলায় পরিকল্পিত পদক্ষেপ ও নীতিগত স্থিতিশীলতা জরুরি—যা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যতের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
MAH – 13954 I Signalbd.com



