অর্থনীতি

সার কারখানায় গ্যাসের দাম এক লাফে ১৩ টাকা বৃদ্ধি

Advertisement

বাংলাদেশে সার উৎপাদনে ব্যবহৃত গ্যাসের দাম হঠাৎই বড় ধরনের সমন্বয়ের মধ্য দিয়ে গেছে। দীর্ঘদিন ১৬ টাকার মধ্যে স্থির থাকা প্রতি ঘনমিটার গ্যাসের দাম এক লাফে বেড়ে ২৯.২৫ টাকা নির্ধারণ করেছে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি)। অর্থাৎ, এক ধাক্কায় ১৩ টাকারও বেশি বৃদ্ধি করা হলো। এই সিদ্ধান্ত দেশের সার শিল্প, কৃষি উৎপাদন, খাদ্য নিরাপত্তা এবং সার আমদানির ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

রোববার ২৩ নভেম্বর বিকেলে এক সংবাদ সম্মেলনে বিইআরসির চেয়ারম্যান ও কমিশনের শীর্ষ কর্মকর্তারা নতুন মূল্য ঘোষণা করেন। এর মধ্য দিয়ে প্রায় দুই মাস ধরে চলা গ্যাসমূল্য পুনঃনির্ধারণের প্রক্রিয়ার আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি ঘটল।

বিইআরসির নতুন ঘোষণা: ১৬ টাকা থেকে ২৯.২৫ টাকা

২০২৫ সালের ৬ অক্টোবর গণশুনানিতে পেট্রোবাংলা ও গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো সার কারখানায় ব্যবহৃত প্রতি ইউনিট গ্যাসের মূল্য ১৬ টাকা থেকে বাড়িয়ে সরাসরি ৪০ টাকা করার প্রস্তাব দিয়েছিল। তবে কমিশনের কারিগরি কমিটি তা পর্যালোচনা করে ২৯.৫ টাকা মূল্য নির্ধারণের সুপারিশ করলেও শেষ পর্যন্ত ২৯.২৫ টাকায় চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।

গ্যাসের দাম বাড়ানোর যৌক্তিকতা হিসেবে কমিশন জানিয়েছে, এলএনজি আমদানির খরচ, ডলার মূল্য বৃদ্ধি, আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির অস্থিরতা, অভ্যন্তরীণ সরবরাহের ঘাটতি এবং উৎপাদন ব্যয় সামাল দিতে এ মূল্য সমন্বয় জরুরি হয়ে পড়েছিল।

কৃষি ও সার উৎপাদনে প্রভাব: উদ্বেগের কেন্দ্রবিন্দু

গণশুনানিতে বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ স্পষ্টভাবে বলেছিলেন, গ্যাসের দাম বাড়ানো হলে তার সরাসরি প্রভাব পড়বে সারের উৎপাদন ব্যয়ে। আর সার উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে তা কৃষিখাতে নতুন চাপ তৈরি করতে পারে, ফলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়বে। যদিও বাংলাদেশ সরকার দীর্ঘদিন ধরে কৃষকদের জন্য সারের দাম স্থিতিশীল রাখতে ভর্তুকি দিয়ে আসছে, এরপরও আন্তর্জাতিক বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা এবং স্থানীয় উৎপাদন খরচের পরিবর্তন পরিস্থিতিকে জটিল করতে পারে।

তিনি আরও বলেন, কৃষির অবদান সামগ্রিক জিডিপিতে কম হলেও খাদ্য নিরাপত্তা ও কর্মসংস্থানে কৃষি খাতের গুরুত্ব অপরিসীম। বিশেষ করে দেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ সরাসরি কৃষি পেশার সঙ্গে যুক্ত এবং আরও অনেকে পরোক্ষভাবে কৃষির ওপর নির্ভরশীল। তাই কৃষিকে সর্বোচ্চ বিবেচনায় রেখে ভারসাম্যপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।

বাংলাদেশে সারের চাহিদা ও গ্যাসের গুরুত্ব

বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত সার হলো ইউরিয়া, যা উৎপাদনের মূল উপাদান হিসেবে প্রাকৃতিক গ্যাসের ওপর শতভাগ নির্ভরশীল। গ্যাস ছাড়া ইউরিয়া সার উৎপাদন সম্ভব নয়। বর্তমানে দেশের কয়েকটি প্রধান সার কারখানা হলো:

  • জামালপুরের জিয়াউর রহমান ইউরিয়া সার কারখানা
  • গাজীপুরের টিটি এম সি
  • নরসিংদীর পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা
  • গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জ সার কারখানা
  • খুলনা ইউরিয়া সার কারখানা

কয়েক বছর আগে নরসিংদীর বৃহত্তম ইউরিয়া কারখানা টিসিডি (টার্নঅ্যারাউন্ড) প্রকল্পের আওতায় আধুনিকীকরণ শেষে উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি করেছে। কিন্তু গ্যাস সরবরাহে ঘাটতি থাকায় এসব কারখানার উৎপাদন ক্ষমতা সবসময় পূর্ণমাত্রায় ব্যবহার করা যায় না।

নতুন দামের ফলে এসব কারখানার উৎপাদন ব্যয়ে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসতে পারে।

গ্যাসের নতুন দাম কৃষকের জন্য কী অর্থ বহন করে?

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে সার উৎপাদন খরচ বাড়বে, তবে সরকার যদি পূর্বের মতোই ভর্তুকি অব্যাহত রাখে, কৃষকের জন্য সরাসরি প্রভাব কম হতে পারে। তবে ভর্তুকির পরিমাণ বাড়লে সরকারের বার্ষিক বাজেটের ওপর চাপ তৈরি হবে।

বাংলাদেশে সরকারের বার্ষিক সার ভর্তুকির পরিমাণ প্রায় ৩০-৩৮ হাজার কোটি টাকা। গ্যাসের মূল্যবৃদ্ধির কারণে এই ভর্তুকি ৪৫ হাজার কোটিরও কাছাকাছি পৌঁছাতে পারে বলে পূর্বাভাস দিয়েছেন জ্বালানি বিশ্লেষকরা।

তবে অন্যদিকে, সরকার যদি ভর্তুকি কমিয়ে বাজারদর বাড়ায়, তাহলে কৃষকের উৎপাদন খরচ বাড়বে, বাজারে খাদ্যের দাম বাড়তে পারে, যা সামগ্রিক মুদ্রাস্ফীতিতে নতুন চাপ সৃষ্টি করবে।

কেন বাড়লো গ্যাসের দাম: পটভূমি বিশ্লেষণ

১. এলএনজি আমদানির খরচ বৃদ্ধি

বাংলাদেশ বর্তমানে অভ্যন্তরীণ গ্যাসক্ষেত্র থেকে পূর্ণ সরবরাহ পাচ্ছে না। ফলে চাহিদা মেটাতে এলএনজি আমদানি করতে হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এলএনজির দাম অস্থিতিশীল হয়ে পড়ায় আমদানি ব্যয় কয়েকগুণ বেড়েছে।

২. ডলারের উচ্চ বিনিময় হার

ডলার সংকট ও বিনিময় হারের বৃদ্ধি আমদানি করা প্রতিটি ঘনমিটার গ্যাসের খরচ বাড়াচ্ছে।

৩. উৎপাদন ঘাটতি ও চাহিদার ব্যবধান

দেশে দৈনিক গ্যাস সরবরাহ ২৭০০–২৮০০ MMCFD, আর চাহিদা প্রায় ৩৫০০ MMCFD। ঘাটতি পূরণে ব্যয়সাপেক্ষ এলএনজি প্রয়োজন হচ্ছে।

৪. সরকারি ভর্তুকি কমানোর লক্ষ্য

সরকার ধীরে ধীরে ভর্তুকি কমানোর নীতি বাস্তবায়ন করছে, যাতে জ্বালানি খাতে টেকসই অর্থনৈতিক কাঠামো গঠন করা যায়।

অতিরিক্ত তথ্য: সার ব্যবস্থাপনা ও কৃষি উৎপাদন

বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ২৬-৩০ লাখ টন ইউরিয়া সারের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে স্থানীয় উৎপাদন ১০-১২ লাখ টনের মতো। বাকি অংশ আমদানি করতে হয়। স্থানীয় সার কারখানার গ্যাস সরবরাহ নিরবচ্ছিন্ন না থাকায় অনেক সময় উৎপাদন কমে যায়, ফলে আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়তে থাকে।

আবার আন্তর্জাতিক বাজারে সারের দাম বৃদ্ধি পাওয়া, লজিস্টিক চ্যালেঞ্জ এবং ডলার সংকট—সব মিলিয়ে সার ব্যবস্থাপনা একটি জটিল চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

বাজারে প্রভাব পড়বে কি?

বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, গ্যাসের দাম বাড়ানোর সিদ্ধান্ত যৌক্তিক হলেও এর পরবর্তী ধাপগুলো অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সরকার যদি—

  • সার কারখানায় গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করে,
  • ভর্তুকি সঠিকভাবে ধরে রাখে,
  • কৃষকের জন্য মূল্য স্থিতিশীল রাখে,

তাহলে বাজারে অস্থিরতা নাও দেখা দিতে পারে।

তবে এটি করতে হলে সরকারের অতিরিক্ত ব্যয়ের প্রয়োজন হবে, যা সামগ্রিক বাজেট ব্যবস্থাপনায় চাপ তৈরি করবে।

অন্যান্য দেশগুলো কীভাবে সার উৎপাদনে গ্যাস ব্যবহার করে?

ভারত, চীন, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরবসহ অনেক দেশ সার উৎপাদনে গ্যাসের দামের সঙ্গে কৃষির স্বার্থের ভারসাম্য রক্ষা করে। ভারত কৃষকদের জন্য সারের দাম স্থির রাখতে বছরে ১ লাখ কোটি রুপির মতো ভর্তুকি দেয়। বাংলাদেশে কৃষিনির্ভর গ্রামীণ অর্থনীতির কারণে একই ধরনের নীতি বহু বছর ধরে অনুসরণ করা হচ্ছে।

ভবিষ্যতে গ্যাস এবং সার বাজারের যে চ্যালেঞ্জগুলো আছে

  • অভ্যন্তরীণ গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন কমে যাওয়া
  • নতুন গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার বা অনুসন্ধানে ধীরগতি
  • এলএনজির আন্তর্জাতিক বাজার ঝুঁকি
  • ডলার সংকট
  • কৃষি উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি
  • জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ফসল উৎপাদন অনিশ্চয়তা

এসব বিষয় সার শিল্পের ওপর সরাসরি চাপ সৃষ্টি করছে।

অর্থনীতিতে সম্ভাব্য প্রভাব

গ্যাসের দাম বৃদ্ধির ফলে কারখানাগুলোর উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। যদি সরকার ভর্তুকি কমায়, তাহলে খাদ্য পণ্যের দাম বাড়তে পারে। এতে—

  • মুদ্রাস্ফীতি বাড়বে
  • কৃষি খাতে বিনিয়োগ কমতে পারে
  • কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে
  • খাদ্য আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়তে পারে

তবে সরকার যদি ভর্তুকি বহাল রাখে, তাহলে ভোক্তা সরাসরি চাপ অনুভব করবে না।

সরকারের পরবর্তী করণীয়

জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা যেসব পদক্ষেপ নেওয়ার পরামর্শ দিচ্ছেন—

  • দীর্ঘমেয়াদি গ্যাস অনুসন্ধান প্রকল্পে দ্রুত বিনিয়োগ
  • এলএনজি ক্রয়ে স্থিতিশীল সরবরাহ নিশ্চিত করা
  • সার কারখানার আধুনিকীকরণ ও দক্ষ প্রযুক্তি ব্যবহার
  • কৃষকের জন্য সারের দাম স্থির রাখার নীতি অব্যাহত রাখা
  • সার বিতরণে স্বচ্ছতা বাড়ানো

MAH – 13945 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button