টানা ১০ মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি
বাংলাদেশে টানা ১০ মাস ধরে খাদ্য মূল্যস্ফীতি দুই অঙ্কের ঘরে রয়েছে, যা সাধারণ জনগণের জন্য একটি গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ১০ দশমিক ৭২ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। এ হার গত বছরের মার্চ থেকে কখনও এক অঙ্কে নামেনি, যা দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলছে।
মূল্যস্ফীতির ক্রমবর্ধমান চাপ
গত বছরের মার্চে সর্বশেষ খাদ্য মূল্যস্ফীতি ৮ দশমিক ৮৭ শতাংশে ছিল। এরপর থেকে এটি ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে, যা গরিব এবং সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রায় বিপুল প্রভাব ফেলেছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের ক্রমবর্ধমান দাম তাদের আয়ের সাথে কোনোভাবে সামঞ্জস্য রাখতে পারছে না। বিশেষ করে চাল, আলু, পেঁয়াজ, মাছ-মাংস, ডিমের মতো পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি সরাসরি দৈনন্দিন জীবনের ব্যয়ে প্রভাব ফেলছে।
সার্বিক মূল্যস্ফীতির অবস্থা
যদিও খাদ্য মূল্যস্ফীতি উচ্চমাত্রায় রয়েছে, তবুও সার্বিক মূল্যস্ফীতির ক্ষেত্রে কিছুটা স্বস্তি দেখা যাচ্ছে। বিবিএসের তথ্য অনুযায়ী, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে সার্বিক মূল্যস্ফীতি কমে ৯ দশমিক ৯৪ শতাংশে নেমেছে, যা ডিসেম্বরের ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশের তুলনায় উল্লেখযোগ্য হ্রাস। এর আগে ২০২৪ সালের সেপ্টেম্বর মাসেও সার্বিক মূল্যস্ফীতি ৯ দশমিক ৯২ শতাংশে ছিল।
মূল্যস্ফীতির অর্থনৈতিক প্রভাব
মূল্যস্ফীতি এক ধরনের গোপন করের মতো কাজ করে। যখন পণ্যের দাম বাড়ে কিন্তু আয় বৃদ্ধি পায় না, তখন সাধারণ মানুষকে ঋণ নিয়ে বা খরচ কমিয়ে জীবনযাপন করতে হয়। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত আয়ের মানুষের জন্য এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ। আয়ের তুলনায় ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় তাদের প্রকৃত ক্রয়ক্ষমতা হ্রাস পায়, যা অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে।
উদাহরণস্বরূপ, ২০২৪ সালের জানুয়ারিতে যে পণ্য ও সেবা ১০০ টাকায় কেনা যেত, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে তা কিনতে ১০৯ টাকা ৯৪ পয়সা খরচ হয়েছে। অর্থাৎ, এক বছরের ব্যবধানে খরচ প্রায় ১০ শতাংশ বেড়েছে।
পণ্যের মূল্যবৃদ্ধির কারণসমূহ
গত ছয় মাসে চাল, আলু, পেঁয়াজ, মাছ, মাংস, ডিমসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এর পেছনে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে:
- জ্বালানির মূল্যবৃদ্ধি: আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানির দাম বাড়ার ফলে পরিবহন খরচ বেড়েছে, যা সরাসরি পণ্যের দামে প্রভাব ফেলেছে।
- আবহাওয়াজনিত সমস্যা: প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যা বা খরার কারণে কৃষিজ উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে, ফলে খাদ্যপণ্যের সরবরাহ কমেছে।
- ডলার সংকট: আমদানি পণ্যের ক্ষেত্রে ডলার সংকট ও বিনিময় হার বৃদ্ধি খাদ্যপণ্যের মূল্যবৃদ্ধির একটি বড় কারণ।
- সরবরাহ শৃঙ্খলার সমস্যা: অভ্যন্তরীণ সরবরাহ ব্যবস্থায় জটিলতা এবং মধ্যস্বত্বভোগীদের অনিয়ন্ত্রিত মুনাফা মূল্যবৃদ্ধিকে আরও তীব্র করেছে।
গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষের দুর্দশা
মূল্যস্ফীতির এই চাপ গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষকে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। নির্দিষ্ট আয়ের ওপর নির্ভরশীল মানুষদের জন্য বাড়তি ব্যয় সামলানো কঠিন হয়ে পড়েছে। অনেক পরিবারকে কম খেয়ে, কম দামে পণ্য কিনে বা ঋণ করে জীবনযাপন করতে হচ্ছে। ফলে পুষ্টির ঘাটতি, স্বাস্থ্যঝুঁকি এবং শিক্ষা খাতে ব্যয় কমানোর মতো সমস্যাও দেখা দিচ্ছে।
সরকারের করণীয়
মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকারকে দ্রুত এবং কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কিছু সম্ভাব্য পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে:
- নিয়ন্ত্রিত বাজার ব্যবস্থা: নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের বাজারে সরাসরি নজরদারি বাড়ানো।
- ভর্তুকি প্রদান: দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য খাদ্যপণ্যে ভর্তুকি বাড়ানো।
- আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নীতির পরিবর্তন: আমদানি খরচ কমাতে আন্তর্জাতিক বাজারে সঠিক কৌশল প্রয়োগ।
- উৎপাদন বাড়ানো: কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ চাহিদা পূরণ করা।
মূল্যস্ফীতি কমানোর সম্ভাবনা
বিশেষজ্ঞদের মতে, মূল্যস্ফীতির এই ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সরকারকে সমন্বিতভাবে কাজ করতে হবে। আর্থিক নীতির পরিবর্তন, সরবরাহ শৃঙ্খলার উন্নতি, এবং জনগণের জন্য সহজলভ্য পণ্য সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে।
উপসংহার
বাংলাদেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতির ধারাবাহিক বৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গরিব ও সীমিত আয়ের মানুষ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। সরকার এবং সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর উচিত দ্রুত কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা, যাতে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আসে এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা স্বাভাবিক হয়।