সাগর উত্তাল, ঝড়ো বাতাসে আটকে গেলো ২০ রোহিঙ্গা
কক্সবাজারের সেন্ট মার্টিনের উত্তাল সমুদ্রের মাঝে ট্রলারসহ আশ্রয় নেওয়া ২০ জন রোহিঙ্গা নাগরিককে নিরাপদে ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি। রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের রাখাইন থেকে আসা নির্যাতিত শরণার্থী, যারা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন চলমান সামরিক সংঘর্ষের কারণে। বর্তমানে তারা বিজিবির (বাংলাদেশ সীমান্তরক্ষী বাহিনী) হেফাজতে রয়েছেন, তবে আবহাওয়া খারাপ থাকায় ফেরত প্রক্রিয়া স্থগিত রয়েছে।
ট্রলারে ২০ রোহিঙ্গার প্রাণের যাত্রা
গত শুক্রবার সকাল ১১ টার দিকে একটি ট্রলার সেন্ট মার্টিনের উত্তর সৈকতে ভেড়ে। ট্রলারে ছিল ২০ জন রোহিঙ্গা — ১৬ জন পুরুষ, ৩ জন নারী এবং ১ জন শিশু। তাঁদের মধ্যে পাঁচজন একই পরিবারের সদস্য। ঝড়ো হাওয়ার কারণে তারা সাগর পাড়ি দিতে গিয়ে সেন্ট মার্টিনে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছিলেন।
সেন্ট মার্টিন ইউনিয়ন পরিষদের ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম বলেন, “রোহিঙ্গারা বর্তমানে বিজিবির হাতে রয়েছেন এবং ট্রলারটিও নিরাপদে রাখা হয়েছে। তারা মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে চলমান রক্তক্ষয়ী সংঘাত থেকে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।”
মিয়ানমারের সংঘাত এবং রোহিঙ্গাদের দুর্দশা
২০১৪ সাল থেকে রাখাইন রাজ্যে শুরু হওয়া সামরিক সংঘাত ২০২৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে তীব্র রূপ নেয়। মিয়ানমারের সরকারি বাহিনী ও আরাকান আর্মির মধ্যে যুদ্ধের ফলে প্রায় ৮০ শতাংশ রাখাইন এলাকা আরাকান আর্মির নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। এই সংঘাতের কারণে দেড় লাখেরও বেশি রোহিঙ্গা গত ১৮ মাসে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য অনুযায়ী, এই শরণার্থীদের অধিকাংশই সংঘাত ও নির্যাতন থেকে পালিয়ে এসেছে। কেউ কেউ কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পরও নিজের দেশেই নিরাপদ না থাকায় বাধ্য হয়ে বাংলাদেশে আসতে হয়েছে।
সেন্ট মার্টিনে রোহিঙ্গাদের নিরাপত্তা ও মানবিক সহায়তা
সেন্ট মার্টিনে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নেওয়ার পর স্থানীয় প্রশাসন এবং বিজিবি তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কাজ করছে। তবে সামুদ্রিক ঝড় এবং উত্তাল সাগর ফেরত প্রক্রিয়ায় বাধা সৃষ্টি করেছে। বিজিবির এক কর্মকর্তা জানান, “আবহাওয়া ভালো হলে শিগগিরই রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর উদ্যোগ নেওয়া হবে।”
এদিকে স্থানীয়দের মধ্যে রোহিঙ্গাদের মানবিক দুর্দশা নিয়ে উদ্বেগ ও সহানুভূতি দেখা যাচ্ছে। সেন্ট মার্টিনের ইউপি চেয়ারম্যান ফয়েজুল ইসলাম বলেন, “আমরা চেষ্টা করছি যাতে রোহিঙ্গারা নিরাপদে এবং মানবিক সহায়তা পেয়ে থাকেন।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দৃষ্টি ও বাংলাদেশের দায়িত্ব
বাংলাদেশ প্রতিবেশি দেশ হিসেবে রোহিঙ্গাদের জন্য আশ্রয় দিয়েছেন দীর্ঘদিন ধরে। তবে প্রতিনিয়ত বেড়েই চলা শরণার্থী প্রবাহ এবং সীমান্তবর্তী এলাকার নিরাপত্তা পরিস্থিতি দেশটির জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হিসেবে রয়ে গেছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমন্বিত সহায়তা ছাড়া এই সংকট মোকাবেলা কঠিন হয়ে পড়বে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা না হওয়া পর্যন্ত এই সমস্যা অব্যাহত থাকবে। তাই দ্রুত আন্তর্জাতিক উদ্যোগ এবং সংলাপ জরুরি।
সেন্ট মার্টিনে আটকে পড়া রোহিঙ্গাদের ঘটনা শুধু সাময়িক সংকট নয়, এটি বিশাল রোহিঙ্গা সমস্যা ও নিরাপত্তা পরিস্থিতির একটি আভাস। রাখাইন রাজ্যের সংঘাতের প্রেক্ষিতে প্রতি বছর লক্ষাধিক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিচ্ছেন। এতে কক্সবাজার ও তার আশপাশের অঞ্চলগুলোতে মানবিক সংকট এবং প্রশাসনিক চাপ বেড়েই চলেছে।
বাংলাদেশ সরকার, বিজিবি, স্থানীয় প্রশাসন ও আন্তর্জাতিক সংস্থা যৌথভাবে কাজ করছে শরণার্থীদের সুরক্ষা ও মানবিক সহায়তা নিশ্চিত করতে। তবে সাগরের ঝড়, সীমান্তের নিরাপত্তা, স্থানীয় জনসংখ্যার চাপ এবং অর্থনৈতিক সীমাবদ্ধতা এই সমস্যাকে জটিল করে তুলেছে।
বিশ্ব সম্প্রদায়ের করণীয় হলো রাখাইনে শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য কার্যকর উদ্যোগ নেয়া এবং শরণার্থীদের নিরাপদ প্রত্যাবাসনের পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা। বাংলাদেশে শরণার্থী সংকট মোকাবেলায় সহায়তার পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থাগুলোকে আরও কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে।
সেন্ট মার্টিনে আটকা পড়া ২০ রোহিঙ্গার গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় এই সংকট কতটা গভীর ও জটিল। সাগর উত্তাল থাকায় তাদের ফেরত পাঠানো সম্ভব হয়নি, কিন্তু মানবিকতার চাহিদা ও শান্তির আকাঙ্ক্ষা অব্যাহত। আন্তর্জাতিক সমন্বয়, স্থানীয় সহযোগিতা এবং সঠিক নীতি গ্রহণ ছাড়া এই সংকট দীর্ঘস্থায়ী হবে।
সেন্ট মার্টিন থেকে রোহিঙ্গাদের ফেরত পাঠানোর প্রস্তুতি নেওয়া হবে আবহাওয়া উন্নতির সঙ্গে সঙ্গে। তবে এর সাথে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের স্থায়ী শান্তি ও নিরাপত্তার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ অপরিহার্য।



