প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে টাস্কফোর্সের অন্তত ১টি সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার
বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে টাস্কফোর্সের সুপারিশমালা থেকে অন্তত একটি করে সুপারিশ বাস্তবায়নের নির্দেশ দিয়েছেন। উপদেষ্টা পরিষদের পরবর্তী বৈঠকে কোন সুপারিশটি বাস্তবায়ন করা হবে, তা জানাতে বলা হয়েছে।
সোমবার রাজধানীর শেরেবাংলা নগরের এনইসি সম্মেলনকক্ষে “বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ টাস্কফোর্স” এর প্রতিবেদন প্রকাশ উপলক্ষে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানানো হয়। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, টাস্কফোর্সের প্রধান কে এ এস মুরশিদ, সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন, সানেমের নির্বাহী পরিচালক ড. সেলিম রায়হান, এবং অন্যান্য বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও নীতিনির্ধারকরা।
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনের মূল সুপারিশ
টাস্কফোর্সের প্রতিবেদনে অর্থনীতি, ব্যাংকিং খাত, অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সামাজিক সুরক্ষা ইত্যাদি বিষয়ে বিশদ বিশ্লেষণ করে সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য সুপারিশগুলো হলো:
- নিয়ন্ত্রক সংস্থার সংস্কার কমিশন (RRC) গঠন: সরকারি নীতিমালা এবং আইনকানুনের পরিবর্তন ও সংশোধনে একটি স্থায়ী কমিশন গঠন করার প্রস্তাব করা হয়েছে।
- বাংলাদেশ বিমানকে দুই ভাগে বিভক্তকরণ: এক অংশকে বিদেশি অভিজ্ঞ সংস্থার মাধ্যমে পরিচালনার সুপারিশ করা হয়েছে।
- জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (NBR) কার্যক্রম তদারকি: আলাদা কমিটি গঠনের প্রস্তাব করা হয়েছে যাতে কর ব্যবস্থা আরও স্বচ্ছ ও জবাবদিহিমূলক হয়।
- Center of Global Excellence এবং Center for Social and Behavioral Change Communication and Research গঠন: আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে গবেষণা এবং নীতিগত পরিবর্তনের জন্য এ ধরনের প্রতিষ্ঠান গড়ার প্রস্তাব করা হয়েছে।
সরকারি সেবার মানোন্নয়নে সামাজিক নিরীক্ষা
পরিকল্পনা ও শিক্ষা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ বলেন, “ভূমি নিবন্ধন কার্যালয়, পুলিশ, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি সরকারি সেবা নাগরিকদের জন্য সহজলভ্য নয়। তাই সামাজিক নিরীক্ষার মাধ্যমে সেবার মান উন্নয়ন করা যেতে পারে।” তিনি আরও বলেন, নাগরিক সমাজের তদারকি কার্যক্রমের মাধ্যমে সেবার মান বৃদ্ধি পাবে এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সহজ হবে।
অ্যান্টি গ্যাং স্কোয়াড গঠনের প্রস্তাব
কে এ এস মুরশিদ বলেন, “যুগ যুগ ধরে চাঁদাবাজি ও দুর্নীতির কথা শুনে আসছি, কিন্তু কার্যকর কোনো উদ্যোগ নেওয়া যায়নি। আমরা মনে করি, স্থানীয় জনগণের সহায়তায় অ্যান্টি গ্যাং স্কোয়াড গঠন করা হলে তা অনেক বেশি কার্যকর হবে।”
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি প্রসঙ্গ
ছাত্ররাজনীতি বন্ধের বিষয়ে তিনি বলেন, “রাজনৈতিক প্রভাব শিক্ষার্থীদের মানসিকতা ও আচরণে নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। অনেক শিক্ষকরাও এতে জড়িয়ে পড়েন, যা শেষ পর্যন্ত আর্থিক দুর্নীতির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। তাই সরকার এই বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করতে পারে।”
অর্থনীতির পুনর্গঠন এবং বিনিয়োগ
অর্থনীতিবিদ ড. সেলিম রায়হান বলেন, “বিনিয়োগের জন্য প্রধান বাধা দূর করতে পারলে বিদেশি বিনিয়োগ বৃদ্ধি পাবে। ১০০টি অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন করার পরিবর্তে নির্বাচিত কিছু অঞ্চলকে উন্নত করা যেতে পারে।”
অ্যাপেক্স ফুটওয়্যার লিমিটেডের এমডি সৈয়দ নাসির মঞ্জুর বলেন, “ব্যাংক দেউলিয়া আইন প্রণয়ন করা উচিত এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগ বন্ধ করে দেওয়া প্রয়োজন। স্থানীয় বিনিয়োগের পরিবেশ তৈরি না করে বিদেশি বিনিয়োগ আকর্ষণ করা সম্ভব নয়।”
ব্যাংক খাতের দুর্বলতা
সিপিডির নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন বলেন, “বিগত সরকারের আমলে ব্যাংক কোম্পানি আইন দুর্বল হয়েছে। রাজনৈতিক বিবেচনায় রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে এবং বেসরকারি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদে পরিবারের সদস্যদের অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে, যা ব্যাংক খাতের স্বচ্ছতায় বড় বাধা।”
টাস্কফোর্সের গঠন ও লক্ষ্য
গত ১১ সেপ্টেম্বর অন্তর্বর্তী সরকার “বৈষম্যহীন টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে অর্থনৈতিক কৌশল পুনর্নির্ধারণ টাস্কফোর্স” গঠন করে। বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (BIDS) সাবেক মহাপরিচালক কে এ এস মুরশিদের নেতৃত্বে গঠিত এই টাস্কফোর্স অর্থনৈতিক নীতি, সামাজিক সুরক্ষা, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং প্রশাসনিক সংস্কার ইত্যাদি বিষয়ে সুপারিশ প্রদান করে। টাস্কফোর্সের লক্ষ্য হলো একটি সমতাভিত্তিক ও টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
উপসংহার
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নির্দেশনা অনুযায়ী, প্রতিটি মন্ত্রণালয়কে অন্তত একটি করে সুপারিশ বাস্তবায়ন করতে হবে। এই নির্দেশনা সরকারি প্রশাসনে স্বচ্ছতা, জবাবদিহি, এবং দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। টাস্কফোর্সের সুপারিশমালা বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ একটি ন্যায়সঙ্গত ও টেকসই উন্নয়নের দিকে অগ্রসর হবে।