অর্থনীতি

ব্যান্ডউইথে ভারত নির্ভরতা কাটছে না: কোটি কোটি ডলার যাচ্ছে প্রতিবেশী দেশে

Advertisement

বাংলাদেশে ইন্টারনেট ব্যবহারের বিস্তার যত বাড়ছে, ততই বাড়ছে ব্যান্ডউইথের চাহিদা। অথচ আশ্চর্যের বিষয়, সেই ব্যান্ডউইথের অর্ধেকেরও বেশি আসছে প্রতিবেশী দেশ ভারত থেকে। দেশের নিজস্ব সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও আজও বাংলাদেশ ব্যান্ডউইথে ভারত নির্ভরতার বেড়াজাল কাটাতে পারেনি। ফলে প্রতিবছর কোটি কোটি ডলার বৈদেশিক মুদ্রা গুনতে হচ্ছে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই নির্ভরতা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়— বরং এটি দেশের ডিজিটাল নিরাপত্তা, তথ্য সার্বভৌমত্ব এবং কৌশলগত স্বাধীনতার ওপর বড় হুমকি তৈরি করছে।

বছরে হারিয়ে যাচ্ছে সাড়ে ৭০০ কোটি টাকার বেশি

বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যবহৃত ব্যান্ডউইথের প্রায় ৫০ শতাংশই বিদেশ থেকে আমদানি করা হয়, যার মূল উৎস ভারত।
টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, শুধুমাত্র গত সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ভারতীয় কোম্পানিগুলোর কাছে বাংলাদেশ ব্যান্ডউইথ বাবদ ২০ কোটি মার্কিন ডলার (প্রায় সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা) পরিশোধ করেছে।

এই অর্থের পুরোটা বিদেশে চলে যাওয়ায়, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়ছে। অথচ একই টাকায় বাংলাদেশ নিজস্ব সাবমেরিন ক্যাবল নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে পারত — যা দীর্ঘমেয়াদে দেশে ইন্টারনেটের মান উন্নয়ন, মূল্য হ্রাস এবং নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারত।

২০২৭ সালে ব্যান্ডউইথের চাহিদা দ্বিগুণেরও বেশি হবে

বিশ্বখ্যাত গবেষণা প্রতিষ্ঠান টেলিজিওগ্রাফি (Telegeography)-এর এক পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, ২০২৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশের ইন্টারনেট ব্যান্ডউইথের চাহিদা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ২৫,০০০ Gbps

বর্তমানে দেশের দুইটি রাষ্ট্রায়ত্ত সাবমেরিন ক্যাবলের সম্মিলিত সক্ষমতা প্রায় ৭,২০০ Gbps। এর মধ্যে প্রথম সাবমেরিন ক্যাবল (SEA-ME-WE-4) ইতিমধ্যে কার্যক্ষমতার মেয়াদ শেষে গেছে, এবং যেকোনো সময় তার সংযোগ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যেতে পারে।

অর্থাৎ, আগামী দুই বছরের মধ্যে বাংলাদেশে ব্যান্ডউইথ ঘাটতির পরিমাণ দাঁড়াবে কমপক্ষে ১৮,০০০ Gbps, যা পূরণ করতে হলে ভারত বা অন্য কোনো দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ ব্যান্ডউইথ আমদানি করতে হবে।

আরও ৩০০ মিলিয়ন ডলার যাবে ভারতকে

এই ঘাটতি পূরণের লক্ষ্যে যদি বাংলাদেশ ভারত থেকে ব্যান্ডউইথ আমদানি অব্যাহত রাখে, তাহলে ২০২৭ সালের মধ্যে দেশটিকে আরও ৩০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার পরিশোধ করতে হবে।

তুলনামূলকভাবে, এই অর্থের অর্ধেক খরচেই নতুন একটি আন্তর্জাতিক মানের সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করা সম্ভব। কিন্তু যথাযথ উদ্যোগ ও প্রশাসনিক অনুমতির জটিলতায় এখনো সে পথে এগোতে পারেনি বাংলাদেশ।

এই টাকা দিয়েই ৮–১০টা ক্যাবল হতো’

মেটাকোর সাবকম লিমিটেডের সিইও আমিনুল হাকিম বলেন,

“আমরা যে পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা ভারতে পাঠিয়েছি, সেই অর্থ দিয়েই দেশে অন্তত ৮ থেকে ১০টি নতুন সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করা যেত। অথচ আমরা নিজের ঘাটতি পূরণ না করে প্রতিবেশী দেশের ওপর নির্ভর করছি — এটি অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে বড় ভুল।”

তিনি আরও বলেন, দেশের আইটিসি (International Terrestrial Cable) অপারেটরদের মাধ্যমে যেভাবে ব্যান্ডউইথ আমদানি হয়, তার অপর প্রান্তের নিয়ন্ত্রণ থাকে ভারতে, ফলে বাংলাদেশের হাতে থাকে না পূর্ণ নিরাপত্তা।

এই পরিস্থিতি দেশের সাইবার সিকিউরিটি ও ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্স সিস্টেমের জন্যও উদ্বেগজনক বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা।

জাতীয় নিরাপত্তায় ঝুঁকি: ই-মেইল পর্যন্ত ট্র্যাকের শঙ্কা

প্রযুক্তিবিদরা সতর্ক করছেন — ভারতীয় নেটওয়ার্কের মাধ্যমে ব্যান্ডউইথ প্রবাহিত হলে, ভারতের আইন অনুযায়ী দেশটি যে কোনো ইন্টারনেট ডেটা ট্রান্সমিশন ইন্টারসেপ্ট (Intercept) করতে পারে।
অর্থাৎ, বাংলাদেশের নাগরিক বা প্রতিষ্ঠানের ই-মেইল, মেসেজ, এমনকি ডেটা প্যাকেটের হেডার ও কনটেন্ট পর্যন্ত তাদের নজরদারিতে পড়তে পারে।

আমিনুল হাকিম বলেন,

“ভারতের আইন অনুযায়ী তাদের ব্যান্ডউইথের ওপর শতভাগ ইন্টারসেপ্ট করার সুযোগ রয়েছে। ফলে আমাদের ৫০ শতাংশ ব্যান্ডউইথ যেহেতু ওদের মাধ্যমে আসে, তাই জাতীয় নিরাপত্তার বড় ঝুঁকি থেকেই যাচ্ছে।”

তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবলের আশায় বাংলাদেশ

এদিকে সরকার ও বেসরকারি খাত একসঙ্গে কাজ করছে নতুন তৃতীয় সাবমেরিন ক্যাবল সংযোগ (SEA-ME-WE-6) বাস্তবায়নের জন্য।
এই ক্যাবলের আন্তর্জাতিক রুট সিঙ্গাপুর থেকে মিয়ানমার পর্যন্ত ইতিমধ্যে স্থাপিত হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ২০২৬ সালের জুনের মধ্যে বাংলাদেশ এই ক্যাবলের সঙ্গে যুক্ত হবে।

এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের নিজস্ব ব্যান্ডউইথ সক্ষমতা আরও কয়েকগুণ বাড়বে, ফলে ভারত নির্ভরতা অনেকটাই কমে আসবে।

তবে অনুমতির জটিলতায় দেরি হচ্ছে

সিডিনেটের সিইও মশিউর রহমান জানিয়েছেন, বাংলাদেশ জলসীমায় ক্যাবল স্থাপনের জন্য প্রয়োজনীয় সরকারি অনুমতি এখনও পাওয়া যায়নি।

“আমাদের প্রকল্পের কাজ সিংগাপুর ও মিয়ানমার পর্যন্ত শেষ। কিন্তু বাংলাদেশের অংশে প্রবেশের জন্য কোস্টগার্ড, এনএসআই ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অনুমতি নিতে হচ্ছে। সব অনুমতি পেলে ২০২৬ সালের এপ্রিলেই আমাদের ক্যাবল চালু করা সম্ভব হবে,” — বলেন তিনি।

এই প্রশাসনিক জটিলতাই এখন প্রকল্প বাস্তবায়নের বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সরকার বলছে— বেসরকারি উদ্যোগে কোনও বাধা নেই

প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ফয়েজ আহমদ তৈয়্যব জানিয়েছেন, সরকার বেসরকারি খাতে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনে কোনো বাধা দেয়নি।

তিনি বলেন,

“আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে নিরাপদ ও নির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যেন আন্তর্জাতিক মান বজায় রেখে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপন করতে পারে, সেটাই আমরা চাই। বর্তমানে ভারত নির্ভরতা কিছুটা বেশি হলেও ভবিষ্যতে আমরা নিজের সক্ষমতার ওপর দাঁড়াতে চাই।”

বর্তমানে রাষ্ট্রায়ত্ত বাংলাদেশ সাবমেরিন ক্যাবল কোম্পানি লিমিটেড (BSCCL)-এর পাশাপাশি তিনটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে সাবমেরিন ক্যাবল লাইসেন্স দিয়েছে সরকার। এর মাধ্যমে ২০২৬-২৭ সালের মধ্যে বাংলাদেশের মোট ব্যান্ডউইথ সক্ষমতা দ্বিগুণ হওয়ার আশা করা হচ্ছে।

ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ছে, কিন্তু অবকাঠামো পিছিয়ে

বাংলাদেশে বর্তমানে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি
২০২০ সালে এই সংখ্যা ছিল মাত্র ১০ কোটি। অর্থাৎ, মাত্র পাঁচ বছরে ৩০ শতাংশের বেশি প্রবৃদ্ধি।
কিন্তু একই সময়ে ব্যান্ডউইথ অবকাঠামো উন্নয়ন হয়েছে মাত্র ১০ শতাংশ, ফলে সরবরাহ ও চাহিদার মধ্যে বিরাট ফাঁক তৈরি হয়েছে।

এই ফাঁক পূরণের জন্য সরকার একাধিক প্রকল্প হাতে নিলেও কাজের ধীরগতি ও প্রশাসনিক জটিলতা বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে বলে বিশেষজ্ঞদের মন্তব্য।

ডিজিটাল বাংলাদেশ’ থেকে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে’ — নির্ভরতা কাটানোই চ্যালেঞ্জ

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষিত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ বাস্তবায়নের অন্যতম শর্ত হলো ডেটা স্বয়ংসম্পূর্ণতা ও নিরাপদ ইন্টারনেট অবকাঠামো

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি বাংলাদেশ নিজের সাবমেরিন ক্যাবল সক্ষমতা দ্রুত বৃদ্ধি করতে না পারে, তাহলে ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য বড় ধাক্কা খেতে পারে।
কারণ, তথ্য ও ডেটা নিরাপত্তা এখন জাতীয় নিরাপত্তার সমান গুরুত্বপূর্ণ।

নিজস্ব সক্ষমতাই একমাত্র সমাধান

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন ডিজিটাল নির্ভর। ব্যাংকিং, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, প্রশাসন — সবখানেই ইন্টারনেট অপরিহার্য।
এই বাস্তবতায় ব্যান্ডউইথ আমদানিনির্ভর কাঠামো শুধু আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং দেশের সার্বভৌমত্ব ও নিরাপত্তার জন্যও দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিপূর্ণ।

তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ, সরকার ও বেসরকারি খাত একসাথে কাজ করে নিজস্ব সাবমেরিন ক্যাবল সক্ষমতা গড়ে তুলতে হবে — যাতে বাংলাদেশ একদিন নিজেই অন্য দেশকে ব্যান্ডউইথ রপ্তানি করতে পারে।

মূল তথ্যসংক্ষেপ:

বিষয়তথ্য
বর্তমান ব্যান্ডউইথ সক্ষমতা৭,২০০ Gbps
২০২৭ সালের সম্ভাব্য চাহিদা২৫,০০০ Gbps
ভারত থেকে আমদানিপ্রায় ৫০%
বছরে ব্যয়সাড়ে ৭০০ কোটি টাকা
২০২৭ পর্যন্ত সম্ভাব্য ব্যয়৩০০ মিলিয়ন ডলার
নতুন সাবমেরিন ক্যাবল২০২৬ সালের জুনে যুক্ত হওয়ার পরিকল্পনা
ইন্টারনেট ব্যবহারকারী সংখ্যাপ্রায় ১৩ কোটি

MAH – 13435 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button