অর্থনীতি

বিএসআরএম-এর ১৪৯ কোটি, স্টিলের ১৮৮ কোটি টাকা লভ্যাংশ

Advertisement

বাংলাদেশের স্টিল শিল্পের শীর্ষস্থানীয় প্রতিষ্ঠান বিএসআরএম গ্রুপ এবারও পুঁজিবাজারে শক্ত অবস্থান ধরে রেখেছে। ২০২৪–২৫ অর্থবছরের জন্য গ্রুপের দুই অঙ্গপ্রতিষ্ঠান বিএসআরএম লিমিটেড এবং বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড বিনিয়োগকারীদের জন্য আকর্ষণীয় নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। এর মধ্যে বিএসআরএম লিমিটেড দেবে ১৪৯ কোটি টাকার বেশি লভ্যাংশ, আর বিএসআরএম স্টিলস লিমিটেড দেবে প্রায় ১৮৮ কোটি টাকা নগদ লভ্যাংশ।

এই ঘোষণা বিনিয়োগকারীদের মধ্যে ইতিবাচক সাড়া ফেলেছে এবং দেশের শেয়ারবাজারে এক নতুন আস্থা সৃষ্টি করেছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শুধু কোম্পানির আর্থিক সাফল্যের প্রমাণই নয়, বরং পুরো ইস্পাত খাতের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধিরও ইঙ্গিত।

দুই কোম্পানির আর্থিক সাফল্যের গল্প

রোববার ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জে প্রকাশিত আর্থিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিএসআরএম লিমিটেডের কর-পরবর্তী নিট মুনাফা দাঁড়িয়েছে ৬১৪ কোটি ১৯ লাখ টাকা, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ৪২ শতাংশ বেশি। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে কোম্পানির নিট মুনাফা ছিল ৪৩২ কোটি ৩৪ লাখ টাকা

কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) বেড়ে হয়েছে ২০ টাকা ৫৭ পয়সা, যা আগের অর্থবছরে ছিল ১৪ টাকা ৪৮ পয়সা। মুনাফার এই ধারাবাহিক বৃদ্ধি প্রতিষ্ঠানটির কার্যকর ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধি ও খরচ নিয়ন্ত্রণের সাফল্যেরই প্রতিফলন।

অন্যদিকে, বিএসআরএম স্টিল লিমিটেড-এর নিট মুনাফা বেড়ে হয়েছে ৫১৭ কোটি ৬৯ লাখ টাকা, যা আগের বছরের ৩৭৯ কোটি ৬৬ লাখ টাকার তুলনায় প্রায় ৩৬ শতাংশ বেশি। এই সময় কোম্পানির শেয়ারপ্রতি আয় (ইপিএস) হয়েছে ১৩ টাকা ৭৭ পয়সা, যেখানে আগের বছর ছিল ১০ টাকা ১০ পয়সা

দুই প্রতিষ্ঠানেরই পরিচালনা পর্ষদ বিনিয়োগকারীদের জন্য ৫০ শতাংশ নগদ লভ্যাংশ ঘোষণা করেছে। অর্থাৎ প্রতি শেয়ারধারী পাবেন ৫ টাকা করে নগদ লভ্যাংশ

বিএসআরএম লিমিটেডের সিদ্ধান্ত ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বিএসআরএম লিমিটেড তাদের মোট মুনাফার প্রায় ২৪ শতাংশ লভ্যাংশ হিসেবে বিতরণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। বাকি ৭৬ শতাংশ সংরক্ষিত থাকবে ভবিষ্যৎ বিনিয়োগ, প্রযুক্তি উন্নয়ন এবং উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য।

কোম্পানির কর্মকর্তারা জানান, নতুন অর্থবছরে বিএসআরএম লিমিটেড আধুনিক প্রযুক্তি সংযোজন, জ্বালানি দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পরিবেশবান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থার দিকে জোর দেবে। ইতিমধ্যে চট্টগ্রাম ও মিরসরাই অঞ্চলে নতুন প্রকল্পের পরিকল্পনাও হাতে নেওয়া হয়েছে।

বিএসআরএম স্টিল লিমিটেডের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি

বিএসআরএম স্টিল লিমিটেড গত অর্থবছরে দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর চাহিদা পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। সেতু, রেললাইন, বন্দর, শিল্পপ্রকল্পসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি নির্মাণকাজে কোম্পানির পণ্যের চাহিদা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে।

কোম্পানিটি তাদের মোট মুনাফার ৩৬ শতাংশের বেশি লভ্যাংশ হিসেবে প্রদান করবে এবং বাকি অর্থ সংরক্ষিত তহবিলে রাখবে। এই সংরক্ষিত অর্থ ভবিষ্যতে নতুন স্টিল রোলিং মেশিন স্থাপন, উৎপাদন সম্প্রসারণ এবং কাঁচামাল আমদানি খাতে ব্যয় হবে বলে জানা গেছে।

বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরে আসছে

বিএসআরএম গ্রুপের এই লভ্যাংশ ঘোষণার পর থেকেই শেয়ারবাজারে ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা গেছে। বিশেষ করে বড় বিনিয়োগকারীদের পাশাপাশি ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরাও আবারও কোম্পানির শেয়ার কেনায় আগ্রহী হয়ে উঠেছেন।

বাজার বিশ্লেষকদের মতে, বিএসআরএমের মতো বড় শিল্পগোষ্ঠীর স্থিতিশীল আর্থিক ফলাফল পুঁজিবাজারে আস্থা ফিরিয়ে আনে। বর্তমানে বাজারে যেখানে কিছু কোম্পানি লোকসানের মুখে, সেখানে বিএসআরএম ধারাবাহিকভাবে মুনাফা বৃদ্ধির যে নজির স্থাপন করেছে, তা বাংলাদেশের কর্পোরেট সেক্টরের জন্য দৃষ্টান্ত হয়ে থাকবে।

বাংলাদেশের ইস্পাত শিল্পে বিএসআরএমের অবস্থান

বাংলাদেশে স্টিল শিল্পের সূচনা থেকেই বিএসআরএম একটি অগ্রণী নাম। ১৯৫২ সালে চট্টগ্রামে যাত্রা শুরু করা এই প্রতিষ্ঠান আজ দেশের বৃহত্তম ইস্পাত উৎপাদক হিসেবে স্বীকৃত। নির্মাণখাতের প্রায় ৬০ শতাংশ স্টিল পণ্যই আসে বিএসআরএমের কারখানা থেকে।

প্রতিষ্ঠানটি “বিল্ডিং এ সেফার নেশন” স্লোগান নিয়ে কাজ করছে—যার লক্ষ্য হলো টেকসই ও নিরাপদ অবকাঠামো নির্মাণে গুণগতমানসম্পন্ন ইস্পাত সরবরাহ করা।

বর্তমানে বিএসআরএম গ্রুপে প্রায় সাত হাজারেরও বেশি কর্মী কাজ করছেন, যারা সরাসরি দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখছেন। এছাড়া প্রতিষ্ঠানটি নিয়মিতভাবে বিভিন্ন সামাজিক দায়িত্ব কর্মসূচি (CSR) পরিচালনা করে থাকে—যার মধ্যে শিক্ষাবৃত্তি, হাসপাতাল সহায়তা এবং দুর্যোগ সহায়তা অন্যতম।

অর্থনৈতিক বিশ্লেষণ ও বিশেষজ্ঞ মতামত

আর্থিক বিশেষজ্ঞদের মতে, বিএসআরএমের লভ্যাংশ ঘোষণা বাংলাদেশের পুঁজিবাজারে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। তারা বলছেন, “বর্তমান অর্থনৈতিক প্রেক্ষাপটে যেখানে কাঁচামালের দাম ও ডলারের বিনিময় হার ওঠানামা করছে, সেখানে বিএসআরএমের মুনাফা বৃদ্ধি একটি শক্ত অর্থনৈতিক সংকেত।”

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, দেশীয় স্টিল শিল্পে বিএসআরএমের মতো কোম্পানিগুলো দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় উৎপাদনশীলতা বাড়াতে সাহায্য করছে। কারণ, দেশীয় বাজারে মানসম্মত ইস্পাত উৎপাদনের ফলে আমদানি নির্ভরতা কমছে, যা বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ হ্রাস করছে।

ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা

বিএসআরএম গ্রুপের চেয়ারম্যান জানিয়েছেন, ভবিষ্যতে গ্রুপটি “সবুজ স্টিল” উৎপাদনের দিকে অগ্রসর হবে, যা কার্বন নিঃসরণ কমাতে সহায়ক হবে। এর পাশাপাশি, কোম্পানি পুনর্নবীকরণযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার ও টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থার ওপর গুরুত্ব দেবে।

দেশে বর্তমানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন প্রকল্পের সংখ্যা বাড়ছে—পদ্মা সেতুর পর মেট্রোরেল, রূপপুর পারমাণবিক কেন্দ্র, বঙ্গবন্ধু টানেলসহ নানা প্রকল্পে উচ্চমানের স্টিলের চাহিদা আরও বাড়বে। ফলে বিএসআরএমের উৎপাদন সক্ষমতা বৃদ্ধির এই উদ্যোগ ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধিকে আরও ত্বরান্বিত করবে।

বিএসআরএম গ্রুপের এই রেকর্ড লভ্যাংশ ঘোষণা শুধু বিনিয়োগকারীদের জন্য সুখবর নয়, বরং বাংলাদেশের শিল্প ও অর্থনীতির জন্যও একটি আশাব্যঞ্জক বার্তা।

এই সাফল্য প্রমাণ করে—যথাযথ পরিকল্পনা, সঠিক ব্যবস্থাপনা ও গুণগত মান বজায় রাখলে দেশীয় শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোও আন্তর্জাতিক মানে পৌঁছাতে পারে। বিএসআরএমের এই অর্জন ভবিষ্যতে অন্যান্য কোম্পানির জন্য প্রেরণার উৎস হয়ে থাকবে।

MAH – 13388 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button