অর্থনীতি

“রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ৩২ বিলিয়ন ডলার, ধরে রাখতে বিদেশি বিনিয়োগ আনতেই হবে”

Advertisement

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ পুনরায় উর্ধ্বমুখী। চলতি বছরের অক্টোবর মাসের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট গ্রস রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩২ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার। তবে অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে দিচ্ছেন, এই অবস্থান দীর্ঘ সময় ধরে ধরে রাখতে হলে রেমিট্যান্স, রফতানি আয়ের পাশাপাশি প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ (FDI) বাড়ানো এবং বিদেশি ঋণের ব্যবহার জোরদার করতে হবে।

রিজার্ভের ওঠা-নামার পটভূমি

করোনা মহামারীর সময় প্রবাসী আয় এবং বৈদেশিক মুদ্রার প্রাপ্তি অনেকাংশে বৈধ পথে বেড়েছিল। হুন্ডির প্রবণতা কমে যাওয়ায় বৈধ রেমিট্যান্সের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। ২০২১ সালের আগস্টে রিজার্ভের পরিমাণ পৌঁছে ৪৮ বিলিয়ন ডলারে, যা তখন রেকর্ড হিসাব ধরা হয়েছিল।

তবে তা স্থায়ী হয়নি। মাত্র দুই বছরের মধ্যে রিজার্ভ প্রায় অর্ধেকে নামে আসে। পরে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক পরিবেশে স্থিতিশীলতা আসার সঙ্গে সঙ্গে রিজার্ভ পুনরায় বৃদ্ধি পেতে শুরু করে। গত মঙ্গলবার (১৪ অক্টোবর) বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশের মোট গ্রস রিজার্ভ ৩২ দশমিক শূন্য ২ বিলিয়ন ডলার পর্যন্ত উন্নীত হয়েছে।

রেমিট্যান্স ও রফতানির ভূমিকা

বাংলাদেশ ব্যাংকের সহকারী মুখপাত্র মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী জানান, “আমরা বিভিন্ন প্রক্রিয়া গ্রহণ করেছি। এক্ষেত্রে প্রবাসীরা নিয়মিত টাকা পাঠাচ্ছেন, সেই সঙ্গে আমাদের রফতানি আয়ও বেড়েছে। সব মিলিয়ে রিজার্ভ উপরের দিকে যাচ্ছে। একটি দেশের অর্থনীতির জন্য তিন মাসের আমদানি বিল পরিশোধের মতো অর্থ থাকলে সেই অর্থনীতিকে সক্ষম অর্থনীতি ধরা হয়। সেই দিক থেকে আমরা এখন অনেক ভালো অবস্থানে আছি।”

বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, বর্তমান রিজার্ভ স্বস্তিদায়ক হলেও দীর্ঘমেয়াদে এটি ধরে রাখার জন্য কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে।

রিজার্ভ ধরে রাখার চ্যালেঞ্জ

অর্থনীতিবিদদের ধারণা, চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয়ের বৃদ্ধি আগের মতো না-ও হতে পারে। অন্যদিকে, আমদানি বাড়লে রিজার্ভের ওপর চাপ পড়বে। এজন্য রফতানি আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরে রাখার পাশাপাশি বিদেশি ঋণ এবং বিনিয়োগকে গুরুত্ব দিতে হবে।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ারগের (CPD) সম্মানীয় ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, “রেমিট্যান্স ও রফতানিকে ইতিবাচক রাখতে হবে। ঋণের অবমুক্তি দ্রুত করতে হবে এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগকে রিজার্ভে ইতিবাচক ভূমিকা রাখার জন্য ব্যবহার করতে হবে। আগামীতে দুইটি চাপ থাকবে—একটি হলো আমদানির চাপ, অন্যটি ঋণ পরিশোধের চাপ। দুই চাপ সামাল দিতে হলে অন্যদিকে আয়ের প্রবাহ দ্রুত বাড়াতে হবে, নাহলে রিজার্ভের ওপর চাপ সৃষ্টি হবে।”

ব্যাংকের স্থিতি এবং পদক্ষেপ

বাংলাদেশ ব্যাংক জানাচ্ছে, আকু পেমেন্ট এবং বৈদেশিক ঋণের পরিশোধের চাপ থাকলেও বড় ধরনের কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। সুতরাং, রিজার্ভে বড় ধরনের পতনের আশঙ্কা নেই।

মোহাম্মদ শাহরিয়ার সিদ্দিকী আরও জানান, “আমদানি মূলত ব্যাংক সরাসরি ফান্ডিং করবে না। বাংলাদেশ ব্যাংক এর আগে কখনও তা করেনি। সরকার শুধু প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু আমদানিতে অর্থ প্রদান করে, যেমন সার আমদানির ক্ষেত্রে বা কৃষি খাতের প্রয়োজন হলে। বাকি সব আমদানির পেমেন্ট ব্যাংকগুলো আন্তঃব্যাংক ট্রানজেকশন এবং প্রবাসী রেমিট্যান্সের মাধ্যমে সম্পন্ন করবে। তাই এত বড় চ্যালেঞ্জ নেই।”

বৈধ পথে প্রবাসী আয় বৃদ্ধি এবং অর্থপাচার রোধ

বিশ্লেষকদের পরামর্শ, প্রবাসী আয়ের প্রবাহকে বৈধ পথে বৃদ্ধি করা এবং অর্থপাচার রোধে সরকারের কঠোর পদক্ষেপ অব্যাহত রাখা অপরিহার্য। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী থাকবে।

রফতানি খাতের অবদান

বাংলাদেশের রফতানি খাত বিশেষ করে বস্ত্র ও পোশাক শিল্প দেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের অন্যতম চালিকা শক্তি। পোশাক খাত থেকে প্রতি বছর বিপুল পরিমাণ ডলার আসে, যা দেশের আমদানি চাহিদা পূরণে সহায়তা করে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রফতানিতে বৈচিত্র্য আনতে এবং নতুন বাজার খুঁজে বের করতে পারলে রিজার্ভ আরও মজবুত হবে।

বিদেশি ঋণ এবং বিনিয়োগ

বর্তমান সময়ে রিজার্ভ বৃদ্ধি ও স্থিতিশীল রাখার জন্য বিদেশি ঋণ এবং প্রত্যক্ষ বিদেশি বিনিয়োগ গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, নতুন শিল্প ও অবকাঠামো প্রকল্পে FDI আকর্ষণ করতে পারলে, দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত হবে।

আগামী দিনের চ্যালেঞ্জ

অর্থনীতিবিদরা সতর্ক করে জানাচ্ছেন, আগামীতে দুটি গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ দেখা দিতে পারে:

  1. আমদানি চাপ – বিদেশি পণ্য ও কাঁচামালের চাহিদা বৃদ্ধি রিজার্ভের ওপর চাপ বাড়াতে পারে।
  2. ঋণ পরিশোধের চাপ – বিদেশি ঋণ ও সুদের পরিশোধ সময়মতো না হলে রিজার্ভে নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারকে রেমিট্যান্স, রফতানি এবং FDI বৃদ্ধিতে জোর দিতে হবে।

অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শক্তিশালী রিজার্ভ

বাংলাদেশ ব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী, দেশের রিজার্ভ তিন মাসের আমদানি বিল পরিশোধের জন্য যথেষ্ট, যা অর্থনীতির স্থিতিশীলতার অন্যতম সূচক। দেশের অর্থনীতি এখন সক্ষম এবং রিজার্ভ স্থিতিশীল।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বৈধ প্রবাসী আয় বৃদ্ধি, রফতানি আয় ধরে রাখা, FDI আকর্ষণ এবং ঋণ ব্যবস্থাপনায় সতর্ক পদক্ষেপ রিজার্ভকে দীর্ঘমেয়াদে শক্তিশালী রাখতে সাহায্য করবে।

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিমধ্যেই স্বস্তিদায়ক অবস্থানে পৌঁছেছে। তবে এটিকে ধরে রাখতে হলে শুধু রেমিট্যান্স বা রফতানি নয়, বিদেশি বিনিয়োগ, ঋণের ব্যবস্থাপনা এবং আমদানি নিয়ন্ত্রণের মতো অন্যান্য অর্থনৈতিক পদক্ষেপও সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের পরিকল্পনা এবং সঠিক অর্থনৈতিক নীতি রিজার্ভকে দীর্ঘমেয়াদে স্থিতিশীল রাখতে মূল ভূমিকা রাখবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি এখন শক্তিশালী হওয়ার পথে, কিন্তু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য সতর্কতার সঙ্গে নীতি গ্রহণ অপরিহার্য।

MAH – 13324 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button