অর্থনীতি

অর্থনীতিতে নোবেল পেলেন ৩ জন

Advertisement

বিশ্বের সর্বোচ্চ সম্মানজনক পুরস্কার নোবেল — আর তার মধ্যে অর্থনীতির নোবেল সবসময়ই বৈশ্বিক আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দু।
২০২৫ সালের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন তিন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ — জোয়েল মোকির (Joel Mokyr), ফিলিপ আগিয়োঁ (Philippe Aghion) এবং পিটার হাওইট (Peter Howitt)

তারা এই পুরস্কার পেয়েছেন “প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও সৃজনশীল ধ্বংসের মাধ্যমে টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পূর্বশর্ত শনাক্তকরণে অসামান্য অবদানের” জন্য।

নোবেল কমিটি জানিয়েছে, তাদের গবেষণা শুধু অর্থনীতির তাত্ত্বিক কাঠামোকেই সমৃদ্ধ করেনি, বরং বাস্তব জগতে নীতিনির্ধারণ, শিল্প-বিপ্লব ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ব্যাখ্যাতেও নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।

পুরস্কার ভাগাভাগি: কারা পেলেন কোন অবদানের জন্য

এই বছরের নোবেল পুরস্কারের অর্ধেক (৫০ শতাংশ) পেয়েছেন আমেরিকান-ইসরায়েলি অর্থনীতিবিদ জোয়েল মোকির
অন্য অর্ধেক সমানভাবে ভাগ করে নিয়েছেন ফরাসি অর্থনীতিবিদ ফিলিপ আগিয়োঁ এবং কানাডিয়ান অর্থনীতিবিদ পিটার হাওইট

নোবেল কমিটির ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে—

“জোয়েল মোকির দীর্ঘ গবেষণা প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন, জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি এবং মানব ইতিহাসে শিল্পবিপ্লবের ধারাবাহিক প্রভাবকে গভীরভাবে ব্যাখ্যা করেছে। অপরদিকে, আগিয়োঁ ও হাওইটের ‘ক্রিয়েটিভ ডেসট্রাকশন’ তত্ত্ব আধুনিক প্রবৃদ্ধির মডেলকে নতুনভাবে সংজ্ঞায়িত করেছে।”

জোয়েল মোকির: ইতিহাস থেকে প্রযুক্তি—অর্থনৈতিক অগ্রগতির গল্পকার

জোয়েল মোকির নর্থওয়েস্টার্ন ইউনিভার্সিটির অর্থনীতি ও ইতিহাসের অধ্যাপক। তার গবেষণা অর্থনীতির ইতিহাস ও প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের ওপর কেন্দ্রিত।

তার অন্যতম বিখ্যাত গ্রন্থ “The Lever of Riches: Technological Creativity and Economic Progress” এবং “A Culture of Growth: The Origins of the Modern Economy”

এই বইগুলোতে তিনি দেখিয়েছেন— কীভাবে ইউরোপীয় রেনেসাঁ, বৈজ্ঞানিক বিপ্লব ও মুক্তচিন্তার সংস্কৃতি আধুনিক শিল্প ও প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ভিত গড়ে তুলেছে।

মোকিরের মতে,

“অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি শুধু মূলধন বা শ্রমের ওপর নির্ভর করে না; বরং সমাজের জ্ঞানচর্চা, সংস্কৃতি ও উদ্ভাবনের মানসিকতার ওপরও নির্ভর করে।”

তার এই দৃষ্টিভঙ্গি অর্থনীতির ইতিহাসকে কেবল অতীতের বর্ণনা নয়, বরং ভবিষ্যতের উন্নয়নের মানচিত্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।

ফিলিপ আগিয়োঁ ও পিটার হাওইট: সৃজনশীল ধ্বংসের যুগল তত্ত্ব

অন্যদিকে ফিলিপ আগিয়োঁ (কলেজ দ্য ফ্রান্স ও লন্ডন স্কুল অব ইকোনমিকস) এবং পিটার হাওইট (ব্রাউন ইউনিভার্সিটি) একসঙ্গে প্রস্তাব করেছিলেন “Schumpeterian Growth Theory” — যা ১৯৯০-এর দশকে অর্থনীতিতে বিপ্লব ঘটায়।

তাদের মডেলটি অস্ট্রিয়ান অর্থনীতিবিদ জোসেফ শুমপেটার-এর “Creative Destruction” তত্ত্বের আধুনিক রূপ।
এই তত্ত্বের মূল ধারণা হলো —

“প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন পুরনো শিল্প ও পণ্যের ধ্বংস ঘটায়, কিন্তু সেই ধ্বংস থেকেই নতুন উৎপাদন, কর্মসংস্থান ও প্রবৃদ্ধির সুযোগ তৈরি হয়।”

আগিয়োঁ ও হাওইট এই ধারণাটিকে গাণিতিকভাবে মডেল করে দেখিয়েছেন যে,
অবিরাম উদ্ভাবনই টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির মূল চালিকাশক্তি।

তাদের তত্ত্ব এখন বিশ্বব্যাপী ব্যবহৃত হয় সরকার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর নীতিনির্ধারণে — যেমন OECD, IMF, ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রবৃদ্ধি কৌশলে।

প্রযুক্তি, উদ্ভাবন ও প্রবৃদ্ধি: কেন এই গবেষণা এত গুরুত্বপূর্ণ

বর্তমান বিশ্বে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কেবল উৎপাদন বাড়ানোর মাধ্যমে আসে না। বরং এটি আসে নতুন প্রযুক্তি, দক্ষতা, এবং উদ্ভাবনের মাধ্যমে।

মোকির, আগিয়োঁ ও হাওইটের গবেষণা দেখিয়েছে—
যে দেশগুলো উদ্ভাবনকে উৎসাহিত করে, নতুন ধারণাকে জায়গা দেয়, এবং পুরনো পদ্ধতির স্থলে নতুন প্রযুক্তি গ্রহণ করে, তারাই দীর্ঘমেয়াদে সমৃদ্ধ হয়।

উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়—
১৮শ শতকে ব্রিটেনের শিল্পবিপ্লব,
২০শ শতকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রযুক্তি বিপ্লব,
এবং ২১শ শতকে দক্ষিণ কোরিয়া ও চীনের ডিজিটাল রূপান্তর —
সবই এই “সৃজনশীল ধ্বংস”-এর প্রমাণ।

নোবেল কমিটির বক্তব্য

নোবেল কমিটির চেয়ারম্যান হেনরিক সোয়েনসন বলেন,

“এই তিন অর্থনীতিবিদের গবেষণা আমাদের শেখায় যে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি একটি জীবন্ত প্রক্রিয়া, যেখানে প্রতিনিয়ত পুরনোকে পেছনে ফেলে নতুনের আগমন ঘটে।
এই প্রক্রিয়াই টেকসই উন্নয়নের প্রকৃত চালিকা।”

তিনি আরও বলেন,

“বর্তমানের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI), অটোমেশন ও সবুজ প্রযুক্তির যুগে তাদের কাজ নতুন করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে। এই গবেষণা ভবিষ্যতের অর্থনীতিকেও পথ দেখাবে।”

বিজয়ীদের প্রতিক্রিয়া

পুরস্কার ঘোষণার পর প্রতিক্রিয়ায় জোয়েল মোকির বলেন,

“আমি এই সম্মান পেয়ে কৃতজ্ঞ। ইতিহাস থেকে আমরা যা শিখেছি তা ভবিষ্যৎকে গড়ার জন্য অমূল্য। প্রযুক্তি ও জ্ঞানের সমন্বয়ই মানব উন্নয়নের ভিত্তি।”

ফিলিপ আগিয়োঁ বলেন,

“উদ্ভাবন ও প্রতিযোগিতা কোনো দেশের শত্রু নয়, বরং সেটিই উন্নতির প্রধান হাতিয়ার।”

পিটার হাওইট জানান,

“আমাদের গবেষণা মূলত মানবসৃষ্ট পরিবর্তনের শক্তিকে বোঝার চেষ্টা। প্রতিটি নতুন প্রযুক্তি আমাদের সম্ভাবনাকে প্রসারিত করে।”

গবেষণার প্রভাব: নীতি ও বাস্তব অর্থনীতিতে প্রয়োগ

এই তিন অর্থনীতিবিদের কাজ শুধু তত্ত্ব নয়, বাস্তবনীতিতেও গভীর প্রভাব ফেলেছে।

১️⃣ ইউরোপীয় ইউনিয়নের উদ্ভাবননীতি:
আগিয়োঁ-হাওইট মডেল অনুসারে, ইউরোপীয় কমিশন উদ্ভাবন-ভিত্তিক প্রবৃদ্ধি নীতি প্রণয়ন করেছে।

২️⃣ শিক্ষা ও গবেষণা বিনিয়োগ:
মোকিরের গবেষণা দেখিয়েছে, জ্ঞানচর্চা ও মুক্তচিন্তা অর্থনীতির চালিকা শক্তি। ফলে উন্নয়নশীল দেশগুলো এখন গবেষণা খাতে বিনিয়োগ বাড়াচ্ছে।

৩️⃣ সবুজ প্রযুক্তির উন্নয়ন:
“সৃজনশীল ধ্বংস” ধারণা সবুজ শক্তি খাতেও প্রযোজ্য — পুরনো দূষণমুখী প্রযুক্তি বাদ দিয়ে নতুন টেকসই প্রযুক্তি গ্রহণের মধ্যে দিয়ে অর্থনীতি রূপান্তরিত হচ্ছে।

নোবেল অর্থনীতি পুরস্কারের ইতিহাসে সংক্ষিপ্ত নজর

অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার (আনুষ্ঠানিকভাবে “The Sveriges Riksbank Prize in Economic Sciences in Memory of Alfred Nobel”) ১৯৬৯ সালে প্রবর্তিত হয়।
এর আগের বছরগুলোতে অর্থনীতি নোবেল তালিকায় ছিল না।

১৯৬৯ সালে প্রথম পুরস্কার পান রাগনার ফ্রিশইয়ান টিনবার্গেন, যারা আধুনিক ইকোনোমেট্রিকসের ভিত্তি স্থাপন করেন।

এরপর থেকে পল স্যামুয়েলসন, আমার্ত্য সেন, রবার্ট সলো, জোসেফ স্টিগলিটজ, পল ক্রুগম্যানসহ বিশ্বখ্যাত অর্থনীতিবিদরা এই পুরস্কার অর্জন করেছেন।

২০২৫ সালের পুরস্কার তাই এই ধারাবাহিকতায় এক নতুন অধ্যায়।

বিশ্ব অর্থনীতিতে নতুন চিন্তার দিকনির্দেশনা

এই বছরের নোবেলজয়ীরা দেখিয়েছেন যে—
অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কেবল সংখ্যার হিসাব নয়, এটি মানব মেধা, প্রযুক্তি ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন।

তাদের কাজ নতুন প্রজন্মের অর্থনীতিবিদদের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে উঠেছে, যারা জলবায়ু পরিবর্তন, ডিজিটাল রূপান্তর এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করছেন।

বিশ্বজুড়ে যখন অর্থনীতি মন্দার চাপ, মুদ্রাস্ফীতি ও প্রযুক্তিগত অসমতায় ভুগছে, তখন এই গবেষণা আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয়—

“উদ্ভাবনই টেকসই প্রবৃদ্ধির একমাত্র পথ।”

২০২৫ সালের অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার শুধু তিনজন ব্যক্তিকে সম্মানিত করেনি; এটি স্বীকৃতি দিয়েছে মানব মেধা, সৃজনশীলতা ও উদ্ভাবনের শক্তিকে

জোয়েল মোকির ইতিহাসের আলোকে দেখিয়েছেন উন্নয়নের সাংস্কৃতিক ভিত্তি,
আর আগিয়োঁ ও হাওইট প্রমাণ করেছেন— সৃজনশীল ধ্বংসই অর্থনীতির নবজাগরণের প্রাণশক্তি।

তাদের গবেষণা ভবিষ্যতের নীতিনির্ধারকদের জন্য এক অমূল্য দিকনির্দেশনা হিসেবে থাকবে,
যা বলবে—
“পরিবর্তনকে ভয় নয়, গ্রহণ করো; কারণ প্রতিটি নতুন উদ্ভাবনই আগামীর সম্ভাবনা।”

MAH – 13310 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button