অর্থনীতি

অবৈধ সংযোগ, জ্বালানি সংকট: ভোগান্তি, অর্থনীতি, রাজনীতি

Advertisement

অবৈধ সংযোগে জ্বালানি সংকট

বাংলাদেশে জ্বালানি খাতে দীর্ঘদিন ধরেই ঘাটতি ও সংকট বিদ্যমান। তেলের মূল্য বৃদ্ধি, গ্যাস সরবরাহের অপ্রতুলতা এবং এলপিজির দাম নিয়ে ভোক্তাদের অসন্তোষ যেন এখন প্রতিদিনের খবর। এর মাঝেই অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান স্পষ্টভাবে জানিয়েছেন—এই সংকট কোনো আকস্মিক পরিস্থিতি নয়, বরং এক শ্রেণির রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীর অবৈধ সংযোগ এবং দুর্নীতির কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে।

শনিবার (১১ অক্টোবর ২০২৫) রাজধানীর একটি অভিজাত হোটেলে আয়োজিত “বাংলাদেশে এলপিজির অর্থনীতি, পরিবেশ ও নিরাপত্তা” শীর্ষক সেমিনারে তিনি এ অভিযোগ তোলেন।

উপদেষ্টা বলেন, “অসংখ্য অবৈধ সংযোগ দেওয়া হয়েছে রাজনৈতিক প্রভাবে। এভাবে দুর্নীতির মাধ্যমে যেসব অপ্রয়োজনীয় গ্যাসকূপ ও লাইন তৈরি করা হয়েছে, তার ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে সাধারণ মানুষ। দেশের জ্বালানি খাতে ঘাটতি সৃষ্টি করে অবৈধভাবে আর্থিক ফায়দা নিচ্ছে এক শ্রেণির প্রভাবশালী।”

বাপেক্স ও অনুসন্ধান কার্যক্রম

বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) দেশীয়ভাবে গ্যাস অনুসন্ধান ও উত্তোলনে নিয়োজিত। কিন্তু উপদেষ্টার ভাষায়, “বাপেক্সের জন্য নতুনভাবে রিগ আনা হলেও অগ্রগতি সন্তোষজনক নয়। তাই বাধ্য হয়ে সরকারকে গ্যাস ও জ্বালানি আমদানির দিকে যেতে হচ্ছে।”

বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে প্রাকৃতিক গ্যাস নির্ভর অর্থনীতি চালাচ্ছে। তবে অভ্যন্তরীণ অনুসন্ধান ও উত্তোলনে কাঙ্ক্ষিত অগ্রগতি না থাকায় ক্রমেই বিদেশি আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এ অবস্থায় শক্তিশালী নীতি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা ছাড়া সংকট সমাধান কঠিন হবে।

এলপিজির বাজার ও মূল্যসঙ্কট

এলপিজি (লিকুইফায়েড পেট্রোলিয়াম গ্যাস) বাংলাদেশের জ্বালানি খাতের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে উঠেছে। তবে এর বেশিরভাগই বিদেশ থেকে আমদানি করতে হয়। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ওঠানামা সরাসরি প্রভাব ফেলে বাংলাদেশে।

উপদেষ্টা জানান, “এলপিজি বিদেশ থেকে আনা তুলনামূলক সহজ, তবে এর দাম বেশি। বেশিরভাগ এলপিজি বেসরকারি খাতে আমদানি করা হয়, কিন্তু তাদের সক্ষমতা সীমিত। বাস্তবে এলপিজির দাম সাধারণ মানুষের জন্য আরও সাশ্রয়ী হওয়া উচিত।”

তিনি স্পষ্ট করে বলেন, “এলপিজির দাম এক হাজার টাকার নিচে হওয়া উচিত।” বর্তমানে বাজারে ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম গড়ে ১২০০-১৩০০ টাকার মধ্যে। এই উচ্চমূল্য সাধারণ মানুষের উপর বাড়তি চাপ তৈরি করছে।

সাধারণ মানুষের ভোগান্তি

রাজধানীসহ সারা দেশের অসংখ্য পরিবার রান্নার জন্য এলপিজির ওপর নির্ভরশীল। অপরদিকে শিল্পখাতও গ্যাস সংকটে বিপর্যস্ত। বিশেষ করে ক্ষুদ্র শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলোতে গ্যাস সরবরাহ কমে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে কর্মসংস্থান ও অর্থনীতিতে।

ভোক্তারা বলছেন, গ্যাস সরবরাহের অব্যবস্থাপনা ও এলপিজির উচ্চমূল্য মিলিয়ে জীবনযাত্রার ব্যয় অসহনীয় হয়ে উঠছে।

অবৈধ সংযোগ: অর্থনীতি ও রাজনীতির ফাঁদ

বাংলাদেশে গ্যাসের অবৈধ সংযোগ নতুন কোনো বিষয় নয়। বছরের পর বছর ধরে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বহু পরিবার ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান অবৈধভাবে সংযোগ নিয়েছে। এতে একদিকে রাষ্ট্রীয় রাজস্ব হারাচ্ছে, অন্যদিকে বৈধ ভোক্তারা বঞ্চিত হচ্ছে ন্যায্য সেবার সুযোগ থেকে।

বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রভাবশালী মহল রাজনৈতিক স্বার্থে অবৈধ সংযোগকে প্রশ্রয় দিয়েছে। এর পেছনে রয়েছে দুর্নীতি, ঘুষ ও লুটপাটের সংস্কৃতি।

সমাধান কোথায়?

উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান জানান, সরকার এ সংকট সমাধানে সক্রিয়ভাবে কাজ করছে। তবে তিনি স্বীকার করেন, কাঙ্ক্ষিত ফল আসছে ধীরগতিতে।

অর্থনীতিবিদ ও জ্বালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন,

  1. অবৈধ সংযোগের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান চালাতে হবে।
  2. বাপেক্সকে আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে শক্তিশালী করা জরুরি।
  3. এলপিজির বাজারে স্বচ্ছতা ও প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে।
  4. দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি নীতি গ্রহণ ছাড়া সংকট নিরসন সম্ভব নয়।
  5. নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে।

আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

বিশ্বজুড়ে জ্বালানি বাজারে অস্থিরতা বিরাজ করছে। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও মধ্যপ্রাচ্যের ভূ-রাজনৈতিক অস্থিরতা গ্যাস ও তেলের দামে অস্বাভাবিক উত্থান ঘটিয়েছে। এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে বাংলাদেশসহ আমদানি নির্ভর দেশগুলোতে।

বাংলাদেশ এখনো জ্বালানি খাতে বহুলাংশে বিদেশি আমদানির ওপর নির্ভরশীল। এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সংকটের প্রভাব থেকে পুরোপুরি রক্ষা পাওয়া সম্ভব নয়।

ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যেই সৌরশক্তি, বায়ু শক্তি ও অন্যান্য নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে নজর দিচ্ছে। তবে বাস্তবে এর অবদান এখনো সীমিত। দেশের ক্রমবর্ধমান চাহিদা মেটাতে নবায়নযোগ্য জ্বালানির পাশাপাশি গ্যাস অনুসন্ধান ও এলপিজি খাতকেও শক্তিশালী করতে হবে।

বাংলাদেশের জ্বালানি সংকটের পেছনে শুধু বৈদেশিক বাজার নয়, বরং অভ্যন্তরীণ দুর্নীতি, অবৈধ সংযোগ ও রাজনৈতিক স্বার্থ বড় ভূমিকা রাখছে। অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি উপদেষ্টার বক্তব্যে আবারও পরিষ্কার হলো—সংকটের মূল কারণ হচ্ছে অব্যবস্থাপনা ও অনিয়ম।

সাধারণ মানুষের ভোগান্তি লাঘব করতে হলে সরকারকে এখনই অবৈধ সংযোগ বন্ধ, এলপিজির দাম নিয়ন্ত্রণ, বাপেক্সকে শক্তিশালী করা এবং দীর্ঘমেয়াদি জ্বালানি পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে হবে। অন্যথায় দেশের অর্থনীতি আরও বড় ধাক্কা খেতে পারে।

MAH – 13258 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button