
বাংলাদেশে আবারও কমানো হয়েছে তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম। অক্টোবর মাসের জন্য নতুনভাবে নির্ধারিত হয়েছে ভোক্তা পর্যায়ের এলপিজির মূল্য। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) মঙ্গলবার (৭ অক্টোবর ২০২৫) এক ঘোষণায় জানায়, ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ২৯ টাকা কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ১,২৪১ টাকা। নতুন দাম কার্যকর হবে আজ সন্ধ্যা ৬টা থেকে।
এছাড়াও অটোগ্যাসের দামও কমানো হয়েছে। অক্টোবর মাসে ভোক্তারা প্রতি লিটার অটোগ্যাস কিনতে পারবেন ৫৬ টাকা ৭৭ পয়সায়।
কেন কমলো এলপিজির দাম?
এলপিজি ও অটোগ্যাসের দাম নির্ধারণে আন্তর্জাতিক বাজারে সৌদি আরামকো কর্তৃক ঘোষিত সৌদি সিপি (Saudi CP) মূল সূচক হিসেবে ব্যবহৃত হয়। এই সিপি অনুযায়ী প্রতি মেট্রিক টনে প্রোপেন ও বিউটেনের দাম কমেছে। অক্টোবর মাসে প্রোপেনের দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ৪৯৫ মার্কিন ডলার এবং বিউটেনের দাম ৪৭৫ মার্কিন ডলার। এই দুইয়ের গড় দাম দাঁড়ায় ৪৮২ মার্কিন ডলার।
বাংলাদেশে আমদানিকৃত এলপিজি মূলত প্রোপেন ও বিউটেনের মিশ্রণ। সাধারণত ৩৫:৬৫ অনুপাতে মিশ্রিত হয়ে বাজারজাত হয়। আন্তর্জাতিক বাজারে এ দামের ওঠানামা সরাসরি প্রভাব ফেলে বাংলাদেশি ভোক্তা পর্যায়ের দামে।
সেপ্টেম্বরের তুলনায় দাম কমলো
গত মাসে, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এ ১২ কেজি সিলিন্ডারের দাম ছিল ১,২৭০ টাকা। এর আগে আগস্ট মাসে দাম আরও বেশি ছিল। এবার অক্টোবর মাসে ২৯ টাকা কমে দাম দাঁড়াল ১,২৪১ টাকা।
অটোগ্যাসের ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। সেপ্টেম্বর মাসে প্রতি লিটার অটোগ্যাসের দাম ছিল ৫৮ টাকা ১৫ পয়সা। এবার তা কমে দাঁড়ালো ৫৬ টাকা ৭৭ পয়সা, অর্থাৎ লিটারপ্রতি ১ টাকা ৩৮ পয়সা কমানো হয়েছে।
বিইআরসি’র ভূমিকা
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) প্রতি মাসে আন্তর্জাতিক বাজার বিশ্লেষণ করে ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজি ও অটোগ্যাসের নতুন দাম ঘোষণা করে। মূলত ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষা এবং বাজারে ভারসাম্য আনার জন্যই এ নিয়মিত মূল্য সমন্বয় করা হয়।
বিইআরসি চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ সংবাদমাধ্যমে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে জানান, আন্তর্জাতিক বাজারে সৌদি সিপি মূল্য কিছুটা হ্রাস পাওয়ায় অক্টোবর মাসের জন্য দেশে এলপিজি ও অটোগ্যাসের দাম সমন্বয় করা হয়েছে।
এলপিজি বাজারে দামের ইতিহাস
বাংলাদেশে ২০২৪ সালে এলপিজির দাম ওঠানামা করেছে প্রায় ১১ বার। এর মধ্যে ৪ বার কমেছে, ৭ বার বেড়েছে।
- দাম বাড়ার মাসগুলো ছিল: জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ, জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বর এবং অক্টোবর।
- দাম কমার মাসগুলো ছিল: এপ্রিল, মে, জুন ও নভেম্বরে।
- অপরিবর্তিত ছিল: ডিসেম্বর মাসে।
এই ওঠানামা ভোক্তাদের জন্য মাঝে মাঝে স্বস্তি এনেছে, আবার কখনও চাপও বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশের বাজারে এলপিজির গুরুত্ব
বাংলাদেশে প্রায় এক দশক ধরে রান্নার জ্বালানি হিসেবে এলপিজির ব্যবহার ক্রমাগত বাড়ছে। একসময় অধিকাংশ পরিবার কেরোসিন বা কাঠ ব্যবহার করলেও বর্তমানে নগর ও শহরতলির প্রায় ৭০% পরিবার রান্নায় এলপিজি ব্যবহার করছে।
এছাড়াও পরিবহন খাতে অটোগ্যাস দিন দিন জনপ্রিয় হচ্ছে। সিএনজির বিকল্প হিসেবে অনেক প্রাইভেট কার, মাইক্রোবাস ও ট্যাক্সিতে অটোগ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে বছরে প্রায় ১২ লাখ টন এলপিজির চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৯০% বেসরকারি খাত আমদানি করে থাকে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে দামের ওঠানামা সরাসরি প্রভাব ফেলে বাংলাদেশের ভোক্তা পর্যায়ে।
ভোক্তাদের প্রতিক্রিয়া
এলপিজি ও অটোগ্যাসের দামে সাম্প্রতিক এই হ্রাস সাধারণ মানুষের মাঝে স্বস্তি এনে দিয়েছে। বিশেষ করে নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য রান্নার খরচ কমানো খুবই গুরুত্বপূর্ণ। একইভাবে পরিবহন খাতের চালকরাও অটোগ্যাসের দাম কমায় কিছুটা খুশি।
রাজধানীর একটি বাজারে গৃহিণী লায়লা আক্তার বলেন—
“প্রতিমাসে গ্যাসের দাম বাড়া কমার কারণে বাজেট নিয়ে দুশ্চিন্তা করতে হয়। এবার দাম কিছুটা কমায় স্বস্তি পেলাম। তবে চাই, দাম যেন স্থিতিশীল থাকে।”
অন্যদিকে এক মাইক্রোবাস চালক জানান—
“অটোগ্যাসের দাম সামান্য কমলেও আমাদের জন্য তা গুরুত্বপূর্ণ। জ্বালানির খরচ কমলে আয় কিছুটা বাঁচে।”
বিশেষজ্ঞদের মতামত
জ্বালানি খাতের বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশের ভোক্তাদের জন্য এলপিজি এখন অপরিহার্য। আন্তর্জাতিক বাজারের পরিবর্তনশীলতা বাংলাদেশের অর্থনীতি ও পরিবারে সরাসরি প্রভাব ফেলে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. ফারুক হোসেন জানান—
“এলপিজি দামের স্থিতিশীলতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। ভোক্তারা যেন প্রতি মাসে দামের ওঠানামায় ভুগতে না হয়, সে জন্য সরকারের নীতিগত পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।”
ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
বাংলাদেশে এলপিজির ব্যবহার আগামী বছরগুলোতে আরও বাড়বে বলে ধারণা করা হচ্ছে। বিশেষ করে শহর ছাড়াও গ্রামীণ এলাকায়ও এলপিজির ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে। তবে ভোক্তাদের জন্য দাম স্থিতিশীল রাখাই হবে বড় চ্যালেঞ্জ।
সরকারও এ খাতে স্থানীয় উৎপাদন বাড়ানোর উদ্যোগ নিচ্ছে। বর্তমানে কয়েকটি কোম্পানি বাংলাদেশেই এলপিজি উৎপাদনের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। যদি তা বাস্তবায়িত হয়, তবে বিদেশি বাজারের ওপর নির্ভরশীলতা কিছুটা কমবে।
অক্টোবর ২০২৫-এ ভোক্তা পর্যায়ে এলপিজির দাম কমানো নিঃসন্দেহে স্বস্তির খবর। রান্নার গ্যাস থেকে শুরু করে পরিবহন খাত—সব ক্ষেত্রেই এর ইতিবাচক প্রভাব পড়বে। তবে দীর্ঘমেয়াদে ভোক্তাদের স্বার্থ রক্ষায় দরকার স্থিতিশীল ও সুষ্ঠু নীতি।
বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের নিয়মিত সমন্বয় ভোক্তাদের জন্য একটি ইতিবাচক উদ্যোগ হলেও আন্তর্জাতিক বাজারের অস্থিরতা এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। তবুও এই মুহূর্তে সাধারণ মানুষ সাময়িক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে পারবে।
MAH – 13214 I Signalbd.com