
বাংলাদেশে কর ফাঁকি দীর্ঘদিন ধরেই রাজস্ব সংগ্রহে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা। দেশের উন্নয়ন, অবকাঠামো নির্মাণ, স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে বিনিয়োগসহ সামগ্রিক অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য রাজস্ব আয় বাড়ানো অত্যন্ত জরুরি। এই রাজস্ব সংগ্রহের অন্যতম প্রধান প্রতিষ্ঠান হলো জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।
সম্প্রতি এনবিআর মাঠ পর্যায়ে কর ফাঁকি প্রতিরোধ এবং রাজস্ব পুনরুদ্ধারের জন্য গোয়েন্দা কার্যক্রম আরও শক্তিশালী করার নির্দেশ দিয়েছে। এই নির্দেশনা মূলত কর অঞ্চলগুলোকে লক্ষ্য করে দেয়া হয়েছে।
এনবিআরের নির্দেশনার মূল উদ্দেশ্য
রোববার (৫ অক্টোবর ২০২৫) সকালে এনবিআরের এক বিবৃতিতে বলা হয়, মাঠ পর্যায়ের কর অঞ্চলসমূহকে গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়াতে বলা হয়েছে। এতে উল্লেখ করা হয়, প্রতিটি কর অঞ্চলে একটি করে বিশেষ গোয়েন্দা ও তদন্ত টিম গঠন করতে হবে। এই টিমগুলো কর ফাঁকি শনাক্ত, তথ্য সংগ্রহ, তদন্ত পরিচালনা এবং প্রয়োজনীয় সুপারিশ করবে।
এনবিআরের সদস্য (কর অডিট, ইন্টেলিজেন্স অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন) এর দপ্তর থেকে জারি করা নির্দেশনায় টিমগুলোর কার্যপদ্ধতি, সুপারিশ প্রণয়নের নীতি, কর ফাঁকি পুনরুদ্ধার প্রক্রিয়া এবং অনুমোদন প্রদানের ধাপ সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে।
কর ফাঁকির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা
নির্দেশনায় স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে, যদি কোনো করদাতার বিরুদ্ধে অস্বাভাবিক আয় প্রদর্শন, রেজিস্টারে কারসাজি, অযৌক্তিকভাবে করমুক্ত আয় প্রদর্শন অথবা সরাসরি কর ফাঁকির প্রমাণ মেলে, তবে তদন্ত টিম তাৎক্ষণিকভাবে ব্যবস্থা নেবে।
এক্ষেত্রে ইনভেস্টিগেশন অ্যান্ড ইন্টেলিজেন্স সেল (IIC)–কে সুনির্দিষ্ট তথ্য জানাতে হবে। পরে সংশ্লিষ্ট কর কমিশনার আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে রাজস্ব পুনরুদ্ধারের অনুমোদন দেবেন।
মাসিক রিপোর্টিং ও জবাবদিহিতা
প্রতিটি কর অঞ্চলকে মাসিক ভিত্তিতে নির্ধারিত ফরমে গোয়েন্দা কার্যক্রমের রিপোর্ট জমা দিতে হবে। পরবর্তী মাসের ১০ তারিখের মধ্যে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডে সেই রিপোর্ট জমা দেওয়া বাধ্যতামূলক।
এনবিআর মনে করছে, এ ধরনের কঠোর পর্যবেক্ষণ ও নিয়মিত জবাবদিহিতা কর ফাঁকি প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
কেন প্রয়োজন গোয়েন্দা কার্যক্রম?
বাংলাদেশে প্রতিবছর বিপুল পরিমাণ অর্থ কর ফাঁকির কারণে রাজস্ব আয়ের বাইরে থেকে যায়। বিভিন্ন গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের সম্ভাব্য জিডিপির তুলনায় কর আদায়ের হার এখনও অনেক কম। উন্নত কিংবা উন্নয়নশীল দেশগুলোর তুলনায় বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত অত্যন্ত নিচে।
এখানে অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ হলো—
- আয়কর প্রদানে অনীহা
- হিসাব গোপন করা
- ভুয়া কাগজপত্র তৈরি
- রেজিস্টারে ঘষা-মাজা
- করমুক্ত আয়ের অপব্যবহার
এমন পরিস্থিতিতে মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম শক্তিশালী করা ছাড়া অন্য কোনো উপায় নেই।
উন্নত দেশে কর গোয়েন্দা কার্যক্রম
বিশ্বের অনেক দেশে কর ফাঁকি রোধে গোয়েন্দা কার্যক্রম একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। উদাহরণস্বরূপ—
- যুক্তরাষ্ট্রে IRS (Internal Revenue Service) কর ফাঁকি শনাক্তে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
- ভারতে ইনকাম ট্যাক্স ডিপার্টমেন্ট নিয়মিত রেইড এবং তদন্ত পরিচালনা করে।
- ইউরোপের বিভিন্ন দেশে কর ফাঁকি প্রতিরোধে ব্যাংক অ্যাকাউন্ট পর্যবেক্ষণ, ডিজিটাল ট্র্যাকিং এবং তথ্য আদান-প্রদান ব্যবহৃত হয়।
বাংলাদেশেও এ ধরণের আন্তর্জাতিক অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে কর গোয়েন্দা কার্যক্রম আরও কার্যকর করা সম্ভব।
এনবিআরের প্রত্যাশা
জাতীয় রাজস্ব বোর্ড আশা করছে, নতুন এ পদক্ষেপের ফলে—
- ফাঁকি দেয়া রাজস্ব পুনরুদ্ধার সহজ হবে
- কর ফাঁকি দেওয়ার প্রবণতা কমবে
- সুষ্ঠু কর সংস্কৃতির বিকাশ ঘটবে
- করদাতাদের মধ্যে আস্থা তৈরি হবে
- দেশের রাজস্ব আয় উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পাবে
এনবিআরের মতে, কর ফাঁকি রোধ করা গেলে দেশকে উন্নয়নের নতুন উচ্চতায় নেওয়া সম্ভব।
কর সংস্কৃতি উন্নয়নের চ্যালেঞ্জ
তবে শুধু গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করাই যথেষ্ট নয়। কর সংস্কৃতি উন্নয়নে আরও কিছু উদ্যোগ প্রয়োজন, যেমন—
- করদাতাদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি
- কর প্রদানে সহজ প্রক্রিয়া
- ডিজিটাল ব্যবস্থার উন্নয়ন
- দুর্নীতি রোধ
- ন্যায্য করনীতি ও স্বচ্ছতা
এছাড়া কর কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমেও এই উদ্যোগ আরও কার্যকর হতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, কর ফাঁকি রোধে গোয়েন্দা কার্যক্রম একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ হলেও দীর্ঘমেয়াদে কর সংস্কৃতি গড়ে তোলাই হবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। যদি করদাতারা বুঝতে পারেন যে তাদের দেওয়া টাকাই দেশের উন্নয়নে কাজে লাগছে, তবে স্বেচ্ছায় কর দেওয়ার প্রবণতা বাড়বে।
অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা মনে করেন, কর ব্যবস্থায় স্বচ্ছতা না আনলে শুধু গোয়েন্দা কার্যক্রম দিয়ে কাঙ্ক্ষিত সাফল্য আসবে না।
বাংলাদেশের অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করতে হলে রাজস্ব আয় বাড়ানো অপরিহার্য। কর ফাঁকি প্রতিরোধ ও কর আদায় বৃদ্ধিতে মাঠ পর্যায়ে গোয়েন্দা কার্যক্রম জোরদার করার এনবিআরের নির্দেশ নিঃসন্দেহে সময়োপযোগী। এখন মূল প্রশ্ন হলো, এই উদ্যোগ কতটা সফলভাবে বাস্তবায়ন করা যায়।
যদি বাস্তবায়ন সঠিকভাবে হয়, তবে এ উদ্যোগ দেশের কর সংস্কৃতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে এবং বাংলাদেশকে উন্নত রাষ্ট্রে পরিণত করার পথ আরও মসৃণ করবে।
MAH – 13174 I Signalbd.com