ভারতের রাজনীতিতে নির্বাচন মানেই তুমুল উত্তেজনা, অভিযোগ-প্রতিযোগিতা আর নতুন নতুন ইস্যুর জন্ম। বিহার বিধানসভা নির্বাচন সামনে রেখে দেশটির রাজনৈতিক অঙ্গনে এখনো সেই একই দৃশ্য। তবে এবারের নির্বাচনী প্রচারণায় আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠেছে “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী” ইস্যু। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বক্তব্যের জবাবে অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন (AIMIM)-এর প্রধান আসাদউদ্দিন ওয়াইসি যে পাল্টা প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন, তা আরও বেশি আলোড়ন তুলেছে। তার বক্তব্যে সরাসরি উঠে এসেছে বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম, যিনি বর্তমানে দিল্লিতে অবস্থান করছেন বলে জানা যায়।
মোদির অভিযোগ: ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যু
সম্প্রতি বিহারে এক নির্বাচনী সমাবেশে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেন, “কংগ্রেস ও রাষ্ট্রীয় জনতা দল (আরজেডি) অনুপ্রবেশকারীদের আশ্রয় দিচ্ছে।” তার দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশ থেকে আসা অবৈধ অনুপ্রবেশকারীরা বিহারের জনসংখ্যা ভারসাম্যে পরিবর্তন আনছে এবং এটি স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা ও বিশেষ করে নারীদের জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে।
এই অভিযোগ মোদির নির্বাচনী প্রচারণার অংশ হলেও, তা রাজ্যজুড়ে রাজনৈতিক বিতর্কের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। কারণ, বিহার দীর্ঘদিন ধরেই সীমান্তবর্তী রাজ্য নয়; অথচ বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর প্রসঙ্গ এখানে কেন তা নিয়েই প্রশ্ন তুলেছেন বিরোধীরা।
ওয়াইসির পাল্টা বক্তব্য
অল ইন্ডিয়া মজলিস-ই-ইত্তেহাদুল মুসলিমীন (AIMIM)-এর নেতা আসাদউদ্দিন ওয়াইসি বরাবরই মোদির সমালোচক হিসেবে পরিচিত। বিহারের সীমাঞ্চল অঞ্চলে তার দল ভালো প্রভাব রাখে। সেখানকার মানুষ মূলত মুসলিম অধ্যুষিত এবং AIMIM বিগত নির্বাচনে এখানেই উল্লেখযোগ্য আসন পেয়েছিল।
মোদির অভিযোগের জবাবে ওয়াইসি বলেন,
“মোদিজি বলেছেন, বিহারে বাংলাদেশি আছে। কিন্তু বাস্তবতা হলো, বিহারে কোনো বাংলাদেশি নেই, বিশেষ করে সীমাঞ্চল অঞ্চলে। তবে, দিল্লিতে বাংলাদেশ থেকে আসা আপনার এক বোন রয়েছেন। তাকে সীমাঞ্চলে আনুন, আমরা-ই তাকে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেব।”
এই বক্তব্যে তার স্পষ্ট ইঙ্গিত ছিল শেখ হাসিনার দিকে।
শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ কেন?
বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২০২৪ সালের আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতা হারান। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি দেশ ছেড়ে ভারতে যান। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে জানা যায়, তিনি তখন থেকে দিল্লিতে বসবাস করছেন, তবে প্রকাশ্যে তেমন দেখা যায়নি।
ওয়াইসির বক্তব্যে শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ তোলার মানে ছিল— মোদি যেভাবে “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীর” কথা তুলছেন, তার বিপরীতে তিনি হাসিনার নাম টেনে ব্যঙ্গাত্মকভাবে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন।
রাজনৈতিক প্রতিক্রিয়া
ওয়াইসির এই বক্তব্য ঘিরে ভারতের রাজনীতিতে নতুন বিতর্ক শুরু হয়েছে। বিজেপি সমর্থকেরা বলছেন, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে দেশের সাবেক মিত্র রাষ্ট্রপ্রধানের নাম টেনে অসম্মানজনক মন্তব্য করেছেন। অন্যদিকে বিরোধীরা মনে করছে, মোদির বাংলাদেশ-ইস্যুকে নির্বাচনী অস্ত্র বানানোর প্রবণতার বিরুদ্ধে তীব্র ব্যঙ্গ করেছেন ওয়াইসি।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বিহার নির্বাচন সবসময় জাতপাত, ধর্ম এবং স্থানীয় ইস্যু ঘিরে আবর্তিত হয়। কিন্তু এবারের নির্বাচন ঘিরে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক প্রসঙ্গও সামনে চলে আসছে। বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশের বিষয়টি বাস্তবে যতটা না গুরুত্বপূর্ণ, তার চেয়ে বেশি তা রাজনৈতিক প্রচারের হাতিয়ার।
বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের প্রেক্ষাপট
ভারত ও বাংলাদেশের সম্পর্ক সবসময়ই পারস্পরিক সহযোগিতা, সীমান্ত নিরাপত্তা এবং অভিবাসন ইস্যুর ওপর নির্ভরশীল। গত কয়েক দশকে বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ভারতের রাজনীতিতে সরাসরি প্রভাব ফেলেছে।
বিশেষ করে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ভারতের ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে কাজ করেছে। সীমান্তে সন্ত্রাস দমন, জলবন্টন ও অর্থনৈতিক সহযোগিতায় বাংলাদেশ-ভারতের সম্পর্ক দৃঢ় হয়েছিল। কিন্তু হাসিনা ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর সম্পর্কের ধরণ বদলে যায়। ভারত সরকার প্রকাশ্যে কিছু না বললেও, দেশটির রাজনীতিতে এ বিষয়টি আলোচনার কেন্দ্রে রয়েছে।
বাংলাদেশি ‘অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যুর ইতিহাস
ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে, বিশেষত আসাম ও পশ্চিমবঙ্গে, দীর্ঘদিন ধরেই বাংলাদেশি অভিবাসী ইস্যু আলোচিত। নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন (CAA) ও জাতীয় নাগরিকপঞ্জি (NRC) নিয়ে গত এক দশকে ভারতের রাজনীতিতে উত্তাল সময় গেছে।
কিন্তু বিহারের ক্ষেত্রে এ ইস্যুটি অনেকটাই নতুন। গবেষকেরা মনে করছেন, মোদি আসলে রাজনৈতিক কৌশল হিসেবে এই বিষয়টি সামনে এনেছেন। কারণ, জাতীয় ইস্যুকে ব্যবহার করে স্থানীয় ভোটারদের প্রভাবিত করা বিজেপির পুরনো কৌশল।
সমালোচনার ঝড়
ওয়াইসির মন্তব্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছে। কেউ বলেছেন, তিনি মোদির প্রচারকে পাল্টা ব্যঙ্গাত্মকভাবে ভেঙে দিয়েছেন। আবার কেউ মনে করছেন, শেখ হাসিনার মতো সাবেক প্রধানমন্ত্রীকে এভাবে টেনে আনা রাজনৈতিক শিষ্টাচারের বাইরে।
বিহারের সাধারণ মানুষও বিভক্ত। সীমাঞ্চল অঞ্চলের মানুষ যেখানে ওয়াইসিকে সমর্থন করছে, সেখানে বিজেপি সমর্থকেরা মোদির বক্তব্যকে সমর্থন দিয়ে বলছেন— “বাংলাদেশি অনুপ্রবেশ সত্যি এবং এটি মোকাবিলা করা জরুরি।”
আন্তর্জাতিক দৃষ্টি
বাংলাদেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, এই বিতর্ক দক্ষিণ এশিয়ার আঞ্চলিক রাজনীতির জটিলতা আরও বাড়িয়ে দিচ্ছে। শেখ হাসিনার নাম ভারতীয় নির্বাচনে ব্যবহার হওয়া বাংলাদেশে সমালোচিত হচ্ছে। অনেকেই বলছেন, এটি বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অযাচিত প্রভাব ফেলতে পারে।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এনডিটিভি, দ্য হিন্দু, টাইমস অব ইন্ডিয়া এবং আল জাজিরাসহ বেশ কয়েকটি পত্রিকা এ বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে প্রকাশ করেছে।
বিহার নির্বাচনকে ঘিরে মোদি ও ওয়াইসির এই বিতর্ক শুধু ভারতের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতেই সীমাবদ্ধ নয়। এর প্রভাব পড়তে পারে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কেও। একদিকে মোদি ‘বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারী’ ইস্যুকে রাজনৈতিক অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছেন, অন্যদিকে ওয়াইসি সেই ইস্যুকে পাল্টা ব্যঙ্গ করছেন শেখ হাসিনার প্রসঙ্গ টেনে।
আগামী দিনে বিহারের ভোটাররা কোন যুক্তিকে গুরুত্ব দেবেন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে নিশ্চিতভাবে বলা যায়, এই বিতর্ক নির্বাচনী প্রচারণায় নতুন মাত্রা যোগ করেছে এবং দুই দেশের সম্পর্কের ওপরও এর প্রভাব অস্বীকার করা যাবে না।
MAH – 13032 I Signalbd.com



