অর্থনীতি

জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৫ শতাংশ সম্ভাবনা, ৪ কারণে চাপ: এডিবি

Advertisement

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি চলতি অর্থবছরে ধীরে হলেও বাড়বে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি)। এডিবির সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২৫-২৬ অর্থবছরে দেশের মোট দেশজ উৎপাদন বা জিডিপি প্রাক্কলিতভাবে ৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে। তুলনামূলকভাবে, গত অর্থবছরের জিডিপি বৃদ্ধি ছিল ৪ শতাংশ।

এডিবি জানিয়েছে, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি কিছুটা স্থিতিশীল থাকলেও দেশী অর্থনীতিতে অভ্যন্তরীণ চাহিদা এখনও দুর্বল। মূলত চারটি কারণের কারণে সামগ্রিক প্রবৃদ্ধিতে চাপ পড়ছে।

১. রাজনৈতিক পরিবর্তন ও অনিশ্চয়তা:
রাজনীতি ও সরকারী নীতি প্রণয়নে অনিশ্চয়তা ব্যবসায়িক পরিবেশে প্রভাব ফেলছে। আসন্ন নির্বাচন ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার কারণে বিনিয়োগকারীরা সতর্ক অবস্থান নিচ্ছেন।

২. ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ:
বন্যা, লঘুচাপ ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে কৃষি এবং উৎপাদন খাতে অস্থিরতা দেখা দিচ্ছে। এতে সরবরাহ শৃঙ্খল ব্যাহত হচ্ছে এবং অভ্যন্তরীণ বাজারে মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পাচ্ছে।

৩. শিল্প খাতে শ্রমিক অস্থিরতা:
কারখানা ও উৎপাদন কেন্দ্রগুলোতে শ্রমিকদের আন্দোলন বা অসন্তোষ উৎপাদন প্রক্রিয়ায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে। বিশেষ করে তৈরি পোশাক ও অন্যান্য শিল্প খাতে এটি উল্লেখযোগ্য।

৪. উচ্চ মূল্যস্ফীতি:
সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছিল ৯.৭ শতাংশ, যা গত অর্থবছরে বৃদ্ধি পেয়ে ১০ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। মূল্যস্ফীতির পেছনে পাইকারি বাজারে সীমিত প্রতিযোগিতা, বাজার তথ্যের ঘাটতি, সরবরাহ শৃঙ্খলে বাধা এবং টাকার অবমূল্যায়ন মূল ভূমিকা রেখেছে।

এডিবি প্রতিবেদনের মূল তথ্য

মঙ্গলবার প্রকাশিত এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট আউটলুক (এডিও) সেপ্টেম্বর সংস্করণ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ভোগ্যব্যয় চলতি অর্থবছরে বৃদ্ধি পাবে। এতে রেমিট্যান্স প্রবাহের বৃদ্ধি ও নির্বাচন-সংক্রান্ত ব্যয় প্রধান ভূমিকা রাখবে।

এডিবির কান্ট্রি ডিরেক্টর হো ইউন জিয়ং বলেন, “ভবিষ্যৎ প্রবৃদ্ধি নির্ভর করবে ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়নের মাধ্যমে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা এবং নির্ভরযোগ্য জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত করার ওপর। দেশের ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এখনও প্রবল। মার্কিন শুল্ক ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সম্পর্কিত অনিশ্চয়তা সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে।”

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের টেকসই প্রবৃদ্ধি অর্জনের জন্য নীতি বাস্তবায়ন এবং কাঠামোগত সংস্কার জরুরি। বিশেষ করে:

  • ব্যাংক খাতের শক্তিশালীকরণ
  • বিনিয়োগ ও ব্যবসায়িক পরিবেশ উন্নয়ন
  • জ্বালানি সরবরাহের নির্ভরযোগ্যতা

রপ্তানি খাতের চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাত দেশের প্রধান রপ্তানি খাত হলেও এর ওপর যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় বাজারের চাপ বাড়ছে। যুক্তরাষ্ট্র ২০ শতাংশ শুল্ক আরোপ করেছে, যা রপ্তানি খাতে চাপ সৃষ্টি করছে। এছাড়া, ইউরোপীয় ইউনিয়নে প্রতিযোগিতা বেড়ে যাওয়ায় রপ্তানিকারকরা মূল্য কমিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার চেষ্টা করছেন।

বিনিয়োগ ও ভোগ্যব্যয়ের অবস্থা

এডিবি বলেছে, ভোগ্যব্যয় প্রধান চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করবে। রেমিট্যান্স প্রবাহ ও নির্বাচন-সংক্রান্ত ব্যয় ভোগ্যব্যয় বাড়াবে। তবে সংকোচনমূলক মুদ্রানীতি এবং রাজস্বনীতি বিনিয়োগকে কিছুটা মন্থর করতে পারে।

সামগ্রিক ঝুঁকি ও সতর্কবার্তা

২০২৬ অর্থবছরের জন্য কিছু ঝুঁকি বিদ্যমান। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংক্রান্ত অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাতের দুর্বলতা এবং নীতি বাস্তবায়নের অনাগ্রহ দেশের প্রবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি করতে পারে। এডিবি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশের অর্থনৈতিক নীতি সঠিকভাবে বজায় রাখা এবং কাঠামোগত সংস্কার দ্রুততর করা অত্যন্ত জরুরি।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা

চলতি অর্থবছরে ৫ শতাংশ জিডিপি বৃদ্ধির সম্ভাবনা থাকলেও দেশের টেকসই প্রবৃদ্ধি নির্ভর করছে ব্যবসা ও বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নের ওপর। স্থিতিশীল জ্বালানি সরবরাহ, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, রপ্তানি খাতের প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা এবং আর্থিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালী করা মূল চ্যালেঞ্জ হিসেবে সামনে আছে।

এডিবি বিশ্বাস করে, যদি বাংলাদেশ এই সব চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে পারে এবং সঠিক নীতি গ্রহণ করে, তাহলে দেশের অর্থনীতি আরও শক্তিশালী ও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে।

সারসংক্ষেপ

  • চলতি অর্থবছরে জিডিপি বৃদ্ধি: প্রাক্কলিত ৫%
  • মূল চাপের কারণ: রাজনৈতিক পরিবর্তন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, শ্রমিক অস্থিরতা, মূল্যস্ফীতি
  • প্রধান প্রবৃদ্ধি চালক: ভোগ্যব্যয়, রেমিট্যান্স বৃদ্ধি, নির্বাচন-সংক্রান্ত ব্যয়
  • ঝুঁকি: আন্তর্জাতিক বাণিজ্য অনিশ্চয়তা, ব্যাংক খাত দুর্বলতা, নীতি বাস্তবায়নের অনাগ্রহ
  • বিশেষ সতর্কতা: রপ্তানি খাতের চাপ, মার্কিন শুল্ক প্রভাব, ইউরোপীয় প্রতিযোগিতা
  • প্রস্তাব: ব্যবসা-বিনিয়োগ পরিবেশ উন্নয়ন, কাঠামোগত সংস্কার, আর্থিক প্রতিষ্ঠান শক্তিশালীকরণ

বাংলাদেশের অর্থনীতি ক্রমেই স্থিতিশীল ও টেকসই হওয়ার পথে আছে। তবে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা, রপ্তানি খাতের চ্যালেঞ্জ এবং আর্থিক খাতের শক্তিশালীকরণ নিশ্চিত না হলে এই প্রবৃদ্ধি হ্রাস পেতে পারে।

MAH – 13087 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button