অর্থনীতি

হুন্ডি কমেছে, বৈধ পথে বাড়ছে প্রবাসী আয়

Advertisement

বাংলাদেশের অর্থনীতির প্রধান ভরসা প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। দীর্ঘদিন ধরে হুন্ডির মতো অবৈধ পথে বিপুল অর্থ দেশে আসলেও সাম্প্রতিক সময়ে পরিস্থিতি বদলাতে শুরু করেছে। রাজনৈতিক পরিবর্তন, প্রণোদনা, স্থিতিশীল ডলার রেট এবং ব্যাংকিং সুবিধার উন্নতির কারণে প্রবাসীরা এখন বৈধ চ্যানেলে টাকা পাঠাতে উৎসাহিত হচ্ছেন। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বেড়েছে, অর্থনীতি কিছুটা স্থিতিশীলতা পাচ্ছে এবং বাজারে ডলারের সংকটও কমেছে।

রেকর্ড পরিমাণ রেমিট্যান্স প্রবাহ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যে জানা গেছে, ২০২৪-২৫ অর্থবছরে দেশে প্রবাসীরা ৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি অর্থ পাঠিয়েছেন। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স প্রবাহ। এর আগে ২০২০-২১ অর্থবছরে রেকর্ড ছিল প্রায় ২৪.৭৭ বিলিয়ন ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্ট দুই মাসেই দেশে এসেছে প্রায় ৪.৯ বিলিয়ন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৮ শতাংশ বেশি।

অর্থনীতিবিদদের মতে, এই রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে এবং মুদ্রার বিনিময় হার নিয়ন্ত্রণে রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। ফলে ডলারের বাজারে অস্থিরতা কমেছে এবং মুদ্রাস্ফীতিও কিছুটা নিয়ন্ত্রণে এসেছে।

হুন্ডি থেকে সরে আসছেন প্রবাসীরা

একসময় প্রবাসীরা উচ্চ বিনিময় হারের লোভে হুন্ডি ব্যবহার করতেন। তবে সাম্প্রতিক সময়ে ব্যাংকিং চ্যানেল ও খোলা বাজারে ডলারের মূল্যের ব্যবধান খুব কমে আসায় হুন্ডির প্রতি আকর্ষণ অনেকটাই কমেছে। বর্তমানে বৈধ ব্যাংকিং চ্যানেলে প্রতি ডলারের বিনিময় প্রায় ১২১.৭৫ টাকা পাওয়া যাচ্ছে, আর খোলা বাজারে এটি প্রায় ১২২.৫০ টাকা। ফলে ঝুঁকিপূর্ণ হুন্ডির বদলে বৈধ উপায় বেছে নিচ্ছেন প্রবাসীরা।

অন্যদিকে, হুন্ডির মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর ঝুঁকি বাড়ছে। বিদেশে বিভিন্ন দেশে অর্থ পাচার রোধে কঠোর নজরদারি চালানো হচ্ছে, যা প্রবাসীদের বৈধ চ্যানেলে ফেরাতে সহায়তা করছে।

সরকারের প্রণোদনা ও উদ্যোগ

প্রবাসীদের বৈধ পথে অর্থ পাঠাতে উৎসাহিত করতে সরকার দীর্ঘদিন ধরে নগদ প্রণোদনা দিয়ে আসছে। বর্তমানে বৈধ চ্যানেলে পাঠানো অর্থের ওপর ২.৫ শতাংশ নগদ প্রণোদনা দেওয়া হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক আরিফ হোসেন খান জানিয়েছেন, এই প্রণোদনা এবং রাজনৈতিক পরিবর্তনের ফলে প্রবাসীদের মধ্যে আস্থা তৈরি হয়েছে।

এছাড়া ব্যাংকগুলোকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে যেন দ্রুত এবং স্বচ্ছভাবে রেমিট্যান্স গ্রাহকদের হাতে পৌঁছে দেওয়া হয়। এতে প্রবাসীরা বৈধ পথে টাকা পাঠাতে আরও আগ্রহী হচ্ছেন।

অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব

রেমিট্যান্স প্রবাহ শুধু বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভই বাড়াচ্ছে না, এর প্রভাব পড়ছে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে। ডলারের সংকট কমে যাওয়ায় আমদানি কার্যক্রম কিছুটা স্বাভাবিক হয়েছে। একইসঙ্গে খাদ্যপণ্য ও জ্বালানি আমদানিতেও চাপ হ্রাস পেয়েছে।

বিশ্বব্যাংকের এক গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, রেমিট্যান্স দরিদ্রতা কমাতে বিশেষ ভূমিকা রাখে। যেসব পরিবার নিয়মিত রেমিট্যান্স পায়, তারা শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বেশি ব্যয় করতে সক্ষম হয়। ফলে মানব উন্নয়ন সূচকেও ইতিবাচক পরিবর্তন আসে।

বিশেষজ্ঞ ও বিশ্লেষকদের মতামত

অর্থনীতিবিদদের মতে, বর্তমান সময়ে রেমিট্যান্স প্রবাহ দেশের অর্থনীতিকে স্বল্পমেয়াদি সংকট মোকাবিলায় যেমন সহায়তা করছে, তেমনি দীর্ঘমেয়াদি উন্নয়নের জন্যও ভিত্তি তৈরি করছে। তারা মনে করেন, এই প্রবাহ স্থায়ী রাখতে হলে প্রবাসী আয়ের ওপর নির্ভরশীল ব্যাংকিং সেবা আরও সহজলভ্য করতে হবে।

তবে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করে বলেন, হুন্ডি পুরোপুরি নির্মূল না হলে বৈধ পথে রেমিট্যান্স প্রবাহে স্থায়ী স্থিতিশীলতা আসবে না। এজন্য বিদেশে বাংলাদেশি শ্রমিকদের নিয়মিত সচেতন করা এবং হুন্ডি প্রতিরোধে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করা জরুরি।

ভবিষ্যতের সম্ভাবনা

বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বৈধ পথে প্রবাসী আয় বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে তা দেশের অর্থনীতিতে দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। সরকারের প্রণোদনা নীতি এবং বৈদেশিক মুদ্রার স্থিতিশীল বিনিময় হার বজায় রাখতে পারলে ২০২৫-২৬ অর্থবছরে রেমিট্যান্স আরও রেকর্ড ছুঁতে পারে।

তবে তারা মনে করিয়ে দেন, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও আন্তর্জাতিক বাজারের অবস্থা এই প্রবাহের ওপর সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারে। সবকিছু অনুকূলে থাকলে রেমিট্যান্স আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় আরও বড় ভূমিকা রাখবে।

এম আর এম – ১৫৩৩,Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button