অর্থনীতি

বাংলাদেশের ডলার সংকট: রিজার্ভ, কারণ ও করণীয়

Advertisement

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভ নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। দেশের সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংক গভর্নর এবং বর্তমান অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন— বর্তমান রিজার্ভ দেশের আপৎকালীন সময়ের জন্য যথেষ্ট নয়।

সোমবার (২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৫) সচিবালয়ে অনুষ্ঠিত মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের বৈঠক শেষে তিনি বলেন, “এখন আমাদের কাছে যে পরিমাণ ডলার আছে তা যথেষ্ট নয়। যদি দেশে বড় ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ধাক্কা আসে, তখন আমরা বিপাকে পড়তে পারি।”

ডলারের বাজারে চাপ কেন?

বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্যপণ্য ও প্রযুক্তিপণ্যের দাম বাড়ায় বাংলাদেশকে বেশি ডলার খরচ করতে হচ্ছে। অন্যদিকে, আমদানির চাহিদা আগের মতোই থাকলেও রপ্তানি আয় এবং রেমিট্যান্স প্রবাহ প্রত্যাশিত হারে বাড়ছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংক ডলারের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে নিয়মিত বাজার থেকে ডলার কিনছে। এতে স্বল্পমেয়াদে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে থাকলেও আমদানিকারকদের উপর বাড়তি চাপ তৈরি হচ্ছে।

অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “ডলারের দাম যদি পুরোপুরি ছেড়ে দেওয়া হয় তবে বাজারে অস্থিরতা তৈরি হবে। আবার একেবারে বেশি হস্তক্ষেপ করলেও সমস্যা বাড়তে পারে। তাই আমাদেরকে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে।”

রিজার্ভের গুরুত্ব কেন এত বেশি?

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শুধু আমদানি বিল পরিশোধের জন্য নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির সুরক্ষা বলয় হিসেবে কাজ করে। জরুরি পরিস্থিতি— যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, যুদ্ধ বা বৈশ্বিক অর্থনৈতিক ধসের সময় রিজার্ভ সবচেয়ে বড় সহায়ক শক্তি।

ড. সালেহউদ্দিন বলেন, “আমি যখন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ছিলাম, তখন সিডর আর আইলার মতো দুর্যোগ হয়েছিল। তখন রিজার্ভ যথেষ্ট না থাকায় নানা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হয়েছে। সেই অভিজ্ঞতা থেকে বলছি, রিজার্ভ বাড়ানো এখন সময়ের দাবি।”

রেমিট্যান্স ও প্রবাসীদের ভূমিকা

বাংলাদেশের ডলার রিজার্ভ টিকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় অবদান রাখছে প্রবাসী আয় বা রেমিট্যান্স। বর্তমানে প্রায় ১ কোটি প্রবাসী বাংলাদেশি নিয়মিত অর্থ পাঠাচ্ছেন।

অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, রেমিট্যান্সের প্রবাহ বাড়াতে হলে হুন্ডি প্রতিরোধ, ব্যাংকিং চ্যানেলে দ্রুত সেবা নিশ্চিতকরণ এবং প্রবাসীদের জন্য বিশেষ প্রণোদনা চালু করা জরুরি।

আমদানির খরচ বনাম রপ্তানি আয়

বাংলাদেশের রপ্তানি আয় মূলত তৈরি পোশাক শিল্পের উপর নির্ভরশীল। যদিও এ খাত থেকে প্রতিবছর প্রায় ৫০ বিলিয়ন ডলারের মতো আয় হয়, তবে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক মন্দা এবং ক্রেতাদের চাহিদা কমে যাওয়ায় এ খাতেও চাপ পড়ছে।

অন্যদিকে, খাদ্যশস্য, জ্বালানি ও প্রযুক্তি পণ্য আমদানির খরচ বেড়ে যাওয়ায় রিজার্ভ থেকে বেশি ডলার খরচ করতে হচ্ছে।

বৈশ্বিক অর্থনীতি ও বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ

রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, বৈশ্বিক তেলের বাজার অস্থিরতা, মার্কিন ডলারের আধিপত্য— সবকিছু মিলিয়ে বাংলাদেশসহ উন্নয়নশীল দেশগুলোর অর্থনীতি চাপের মধ্যে রয়েছে।

বাংলাদেশে মুদ্রাস্ফীতি এখন দুই অঙ্কের কাছাকাছি। চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে সাধারণ মানুষ বিপাকে পড়েছে।

সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিপিআরসি জানিয়েছে— ৭০ শতাংশ মানুষ নিত্যপণ্যের দাম নিয়ে অস্বস্তিতে আছে।

সরকারের উদ্যোগ

অর্থনৈতিক বৈঠকে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে—

  • চট্টগ্রামের শাহ আমানত আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ে উন্নীত করে বড় বিমান ওঠানামার উপযোগী করা হবে।
  • ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কন্ট্রোল রুম আধুনিকায়ন করা হবে।
  • দেশের অভ্যন্তরে অকটেন ঘাটতি মেটাতে নতুন করে আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

এই পদক্ষেপগুলো দেশের যোগাযোগ ও জ্বালানি খাতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে বলে আশা করছে সরকার।

ভবিষ্যৎ করণীয়

অর্থনীতিবিদদের মতে, বাংলাদেশকে এখনই কিছু কৌশল নিতে হবে—

  1. রপ্তানি খাত বৈচিত্র্য করা – শুধু পোশাক নয়, আইটি, কৃষিপণ্য, চামড়া, ওষুধ ইত্যাদি খাতে রপ্তানি বাড়াতে হবে।
  2. রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়ানো – প্রবাসীদের জন্য ব্যাংকিং সেবা আরও সহজ করতে হবে।
  3. অপ্রয়োজনীয় আমদানি কমানো – বিলাসী পণ্য বা কম প্রয়োজনীয় আমদানির উপর নিয়ন্ত্রণ জোরদার করা দরকার।
  4. বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি – বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করতে ব্যবসার পরিবেশ উন্নত করা জরুরি।
  5. ডলার বিকল্প খোঁজা – আঞ্চলিক বাণিজ্যে স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহার বাড়াতে হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি দীর্ঘদিন ধরে স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি অর্জন করে আসছে। তবে বৈশ্বিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি ও ডলার সংকট এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদের মতে, “রিজার্ভ শুধু আমদানির জন্য নয়, এটি দেশের অর্থনীতির নিরাপত্তা বলয়। তাই আমাদেরকে এখনই সতর্ক হতে হবে।”

বাংলাদেশের ডলার রিজার্ভ কেবল সংখ্যা নয়, বরং জাতীয় অর্থনীতির স্থিতিশীলতার প্রতীক। সঠিক নীতি, প্রবাসী আয়ের প্রবাহ বৃদ্ধি এবং রপ্তানি খাত শক্তিশালী করার মাধ্যমে এ সংকট মোকাবিলা সম্ভব।

MAH – 12974 I Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button