ব্যাংক খাতে নারী কর্মী কমেছে, বলছে বাংলাদেশ ব্যাংক

দেশের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে নারী কর্মী সংখ্যা আবারও কমে গেছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রকাশিত প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গত ছয় মাসে ব্যাংক খাতে নারী কর্মী প্রায় দুই হাজারজন কমেছে, যা মোট কর্মীর প্রায় ৫ শতাংশ।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি, বেসরকারি ও বিদেশি তফসিলি ব্যাংক এবং অন্যান্য আর্থিক প্রতিষ্ঠানে গত বছরের জুলাই-ডিসেম্বরে মোট নারী কর্মীর সংখ্যা ছিল ৩৭,৬৪৯ জন। চলতি বছরের প্রথমার্ধে (জানুয়ারি-জুন) এই সংখ্যা কমে দাঁড়িয়েছে ৩৫,৭৮২ জনে। অর্থাৎ ছয় মাসের ব্যবধানে ব্যাংক খাতে নারী কর্মী প্রায় দুই হাজার কমেছে।
নারীদের জন্য কর্মপরিবেশে অবনতি
প্রতিবেদন অনুযায়ী, নারীদের জন্য সহায়ক কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও, চলতি বছরের প্রথমার্ধে তা আরও সীমিত হয়েছে। বিশেষ করে অফিস সময়ের পর নারীদের যাতায়াত সুবিধা অনেকটা কমেছে।
গত বছরের শেষ ছয় মাসে ব্যাংকগুলোর ৫২ শতাংশ নারী কর্মী এই সুবিধা পেতেন। কিন্তু চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে এই হার কমে মাত্র ৩৭ শতাংশে নেমেছে। এর ফলে নারীরা সন্ধ্যা ছয়টার পর নিরাপদে অফিস থেকে যাতায়াত করতে পারছেন না।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ৬১টি তফসিলি ব্যাংকে মোট কর্মী সংখ্যা ২,১৩,০০০ এর বেশি, যার মধ্যে নারী কর্মী মাত্র ১৭ শতাংশ। বাকি ৮৩ শতাংশ পুরুষ। ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানেও নারী কর্মীর হার প্রায় সমান, অর্থাৎ প্রতি পাঁচজন পুরুষ কর্মীর বিপরীতে একজন নারী কর্মী।
নারীর অবস্থান: প্রারম্ভিক ও মধ্যবর্তী পর্যায়ে বেশি
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ব্যাংক খাতে কর্মরত নারীদের মধ্যে প্রারম্ভিক ও মধ্যবর্তী পর্যায়ে নারীদের উপস্থিতি বেশি। উচ্চপদে নারীর সংখ্যা এখনও অত্যন্ত কম।
একজন নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বেসরকারি ব্যাংকের নারী কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, “নারীদের পদোন্নতির ক্ষেত্রে মাতৃত্বকালীন ছয় মাসের ছুটিকে প্রায়ই বিবেচনা করা হয় না। ডে কেয়ার সুবিধা ও যাতায়াত ব্যবস্থায় বৈষম্য এখনো বিদ্যমান। বেশিরভাগ ব্যাংক সন্ধ্যা ছয়টার পর নারী কর্মীদের অফিস ছাড়ার নিয়ম মানে না। গত পাঁচ বছরে আমার পরিচিত সাতজন নারী কর্মকর্তাকে সন্তান পালন ও পারিবারিক দায়ের কারণে চাকরি ছেড়ে দিতে হয়েছে।”
তিনি আরও জানান, ক্রেডিট বিভাগে নারীদের অন্তর্ভুক্তি কম। এসব পরিস্থিতি অনেক ব্যাংকে নারীদের জন্য অলিখিত নিয়মে পরিণত হয়েছে।
উচ্চপর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ কম
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ব্যাংক খাতে নারীর অংশগ্রহণ ধীরে ধীরে বাড়লেও, সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী পদে নারীর সংখ্যা এখনও সীমিত। বিশেষভাবে বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে উচ্চপর্যায়ের নারী কর্মীর হার অত্যন্ত কম।
- রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে উচ্চপর্যায়ের নারীর অংশগ্রহণ ১৫.৩০ শতাংশ।
- বিদেশি ব্যাংকে এই হার প্রায় ১৪ শতাংশ।
- বেসরকারি ব্যাংকে মাত্র ৭.৮৫ শতাংশ।
বিদেশি ব্যাংকগুলোতে বোর্ড বা নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ সবচেয়ে বেশি, প্রায় ১৭.২৪ শতাংশ। রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংকে পরিচালনা পর্ষদে নারী অংশগ্রহণ সবচেয়ে কম, মাত্র ৪ শতাংশ।
নারীর অংশগ্রহণ বাড়াতে চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবিব বলেন, “দেশের ব্যাংক খাতে বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের সংকট চলছে। খেলাপি ঋণ, অর্থনৈতিক চাপ ও প্রশাসনিক সংকটের কারণে নারীবান্ধব কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করা ব্যাংকগুলোর জন্য চ্যালেঞ্জ। পাশাপাশি পারিবারিক দায়ের কারণে অনেক নারী ব্যাংকিং ক্যারিয়ার পুরোপুরি ব্যবহার করতে পারছেন না। তবে যদি সুবিধা বৃদ্ধি ও কর্মপরিবেশ উন্নত করা হয়, নারীর অংশগ্রহণ বৃদ্ধি সম্ভব।”
কোন ব্যাংকে নারী বেশি?
প্রতিবেদনে চারটি ব্যাংকের ধরন অনুযায়ী নারীর উপস্থিতি বিশ্লেষণ করা হয়েছে:
- বেসরকারি বাণিজ্যিক ব্যাংক: ৪৩টি ব্যাংকে মোট ২৫,০৫০ নারী কর্মী।
- রাষ্ট্রমালিকানাধীন ব্যাংক: ৬টি ব্যাংকে মোট ৮,৭৪৮ নারী কর্মী।
- বিশেষায়িত ব্যাংক: ৩টি ব্যাংকে মোট ১,৯৫২ নারী কর্মী।
- বিদেশি ব্যাংক: ১,০৩২ নারী কর্মী।
ইস্টার্ন ব্যাংকের প্রায়োরিটি ও উইমেন ব্যাংকিং প্রধান তানজেরি হক বলেন, “মধ্যবর্তী পর্যায়ের নারী কর্মকর্তাদের ঘাটতি ব্যাংক খাতে নারীর সংখ্যা কমানোর মূল কারণ। অনেক নারী পরিবার ও সন্তান পালন দায়িত্বের কারণে চাকরি ছেড়ে দেন। এছাড়া অনেক প্রতিষ্ঠান এখনও নারীর নেতৃত্বে পক্ষপাতের প্রবণতা দেখায়।”
নারীর জন্য সম্ভাবনা
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদনে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানোর জন্য কিছু সুপারিশও করা হয়েছে:
- ডে কেয়ার সুবিধা বৃদ্ধি – শিশু সমর্থন কেন্দ্র এবং মাতৃত্বকালীন সুবিধা নিশ্চিত করা।
- যাতায়াত ব্যবস্থা উন্নয়ন – সন্ধ্যা ছয়টার পর নিরাপদ যাতায়াত নিশ্চিত করা।
- উচ্চপদে নারীর অংশগ্রহণ – নীতিনির্ধারণী ও সিদ্ধান্ত গ্রহণ পর্যায়ে নারীর সংখ্যা বৃদ্ধি।
- প্রশিক্ষণ ও উন্নয়ন – নেতৃত্ব ও দক্ষতা উন্নয়নে নারীদের জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি।
অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবিব বলেন, “যদি এই সব পদক্ষেপ বাস্তবায়ন করা হয়, তাহলে ভবিষ্যতে ব্যাংক খাতে নারীর অংশগ্রহণ অনেক বেশি বৃদ্ধি পাবে।”
বাংলাদেশ ব্যাংকের সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে স্পষ্ট, ব্যাংক খাতে নারী কর্মী সংখ্যা কমে যাওয়া একটি গুরুতর চিত্র। প্রারম্ভিক পর্যায়ে নারীর উপস্থিতি ভালো হলেও মধ্যবর্তী ও উচ্চপর্যায়ে নারীর সংখ্যা এখনও অপ্রতুল। ডে কেয়ার, যাতায়াত ও পদোন্নতির সুযোগ বাড়ানো না হলে এই ফাঁক আরও বড় হতে পারে।
অতএব, নারীদের জন্য আরও সহায়ক কর্মপরিবেশ তৈরি করা, বৈষম্য দূর করা এবং নেতৃত্বে নারীর অংশগ্রহণ বাড়ানো দেশের ব্যাংক খাতকে আরও শক্তিশালী ও সমতাপূর্ণ করবে।
MAH – 12887 Signalbd.com