বিশ্ব

গাজায় অপুষ্টিতে ৮০ শিশুসহ ১০১ ফিলিস্তিনির মৃত্যু

ইসরায়েলি হামলা ও তীব্র খাদ্য সংকটে গাজার মানুষ যেন দিন দিন আরও বেকায়দায় পড়ছে। বিশেষত শিশুরা অপুষ্টিতে মৃত্যুর মুখে পড়ছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় জানায়, চলমান সংঘাতের ২১ মাসের বেশি সময়ে অপুষ্টির কারণে ১০১ জন ফিলিস্তিনি মারা গেছে, যার মধ্যে ৮০ জন শিশু।

আজ মঙ্গলবার এক বিবৃতিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় অপুষ্টিতে আক্রান্ত হয়ে মারা গেছেন ৩৩ জন, তার মধ্যে ১২ জন শিশু। গাজার আল-শিফা হাসপাতালের পরিচালক মোহাম্মদ আবু সালমিয়ার কথায়, গাজায় বর্তমানে প্রায় ৯ লাখ মানুষ ক্ষুধায় ভুগছেন, আর এর মধ্যে প্রায় ৭০ হাজার শিশু অপুষ্টিতে রয়েছে।

গাজার অপুষ্টি সংকট: শিশু থেকে কর্মী—সবাই বিপন্ন

১৪ বছর বয়সী মোসাব আল-দেবস গাজার আল-শিফা হাসপাতালে ভর্তি। তীব্র অপুষ্টি তাকে সম্পূর্ণ দুর্বল করে তুলেছে। এমন পরিস্থিতি শুধু শিশুদেরই নয়, জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনআরডব্লিউর (UNRWA) কর্মী ও চিকিৎসকরাও অনাহারে বেহুঁশ হয়ে পড়ছেন।

ইউএনআরডব্লিউর প্রধান ফিলিপ লাজ্জারিনি বলেন, “অনাহার ও অবসাদের কারণে আমাদের অনেক কর্মী কাজ করতে করতে সংজ্ঞাহীন হয়ে পড়ছে।” তিনি কর্মীদের কাছ থেকে বহুবার এমন সংকেত পেয়েছেন যে তারা আর এই যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে যেতে পারছে না।

ত্রাণ সংকট ও লুটপাটের মাঝে ফিলিস্তিনিরা

গাজার মানুষরা খাবারের জন্য হাহাকার করছে। জাতিসংঘের মাধ্যমে সীমিত পরিমাণ ত্রাণ পৌঁছে দেওয়া হলেও, সেখানে লুটপাট এবং নিরাপত্তার অভাবের কারণে কার্যকর সহায়তা পৌঁছানো দুষ্কর।

ত্রাণ কেন্দ্রে খাবারের জন্য আসা ফিলিস্তিনিদের ওপর নির্বিচার গুলি চালানো হচ্ছে। গাজা হিউম্যানিটারিয়ান ফাউন্ডেশন (জিএইচএফ) পরিচালিত বিতর্কিত ত্রাণকেন্দ্রগুলোতে নিরাপত্তার অভাবের ফলে অন্তত ৭ মে থেকে এখন পর্যন্ত এক হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারিয়েছে।

লাজ্জারিনি অভিযোগ করেন, “ত্রাণ কেন্দ্রগুলোতে যাওয়া ফিলিস্তিনিদের ওপর ইসরায়েলের স্নাইপারদের গুলি নির্বিচারে হয়। এই কেন্দ্রগুলো যেন মৃত্যুর ফাঁদ।”

সাংবাদিকরাও বিপন্ন: অনাহারে মৃত্যুর মুখে

গাজার অনাহার ও ত্রাণ সংকট শুধু সাধারণ মানুষের নয়, সেখানে অবস্থানরত সাংবাদিকরাও ঝুঁকির মধ্যে রয়েছেন। বার্তা সংস্থা এএফপির সাংবাদিকদের সংগঠন এক চিঠিতে উল্লেখ করেছে, দ্রুত পদক্ষেপ না নিলে সাংবাদিকরাও অনাহারে মারা যেতে পারেন।

ইসরায়েলি হামলা ও মানবিক দুর্ভোগ: গাজা এক মানবিক বিপর্যয়

গাজায় ইসরায়েলি বিমান হামলা ও স্থল অভিযান অব্যাহত রয়েছে। আজ ভোর থেকে এককালে অন্তত ৫১ জন নিহত হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে ১৪ জন ত্রাণ সংগ্রহ করতে গিয়ে নিহত হয়েছেন। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য মতে, ২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর থেকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলি হামলায় গাজায় ৫৯ হাজারের বেশি মানুষ নিহত হয়েছেন।

আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া: যুদ্ধবিরতির জন্য আহ্বান

গাজায় মানবিক দুর্ভোগ ক্রমেই বাড়ছে। তাই যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, অস্ট্রেলিয়া, কানাডাসহ ২৮টি দেশ এবং ইউরোপীয় ইউনিয়ন যৌথভাবে গতকাল এক বিবৃতি দিয়েছে।

তারা বলেছে, “গাজার মানুষ এখন এমন এক দুর্ভোগের মধ্যে আছেন যা কখনোই দেখা যায়নি।” বিবৃতিতে যুদ্ধবিরতি, জিম্মিদের মুক্তি, এবং জরুরি মানবিক সহায়তার অবাধ প্রবাহের আহ্বান জানানো হয়েছে।

তবে এই আহ্বানকে ইসরায়েল ‘বাস্তবতা বিচ্ছিন্ন’ বলে উপেক্ষা করেছে।

গাজার অপুষ্টি সংকটের গভীর বিশ্লেষণ

গাজার বর্তমান পরিস্থিতি ও খাদ্য নিরাপত্তা

গাজা উপত্যকা, প্রায় ২০২৫ সালের মধ্য পর্যন্ত প্রায় ২০ লক্ষ মানুষের বাসস্থান। দীর্ঘকালীন সংঘাত ও অবরোধের কারণে খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্যসেবা সব ক্ষেত্রেই বড় সংকট চলছে। ত্রাণসহায়তা সীমিত, এবং অবরোধের কারণে খাদ্যদ্রব্যের সরবরাহ বাধাগ্রস্ত।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, খাদ্য সংকটের সঙ্গে যুদ্ধ, অবরোধ, অব্যাহত সহিংসতা যুক্ত হয়ে গাজাকে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়ের মুখে ফেলেছে। ত্রাণের অভাবে অপুষ্টির মাত্রা এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে, যা একটি স্বাস্থ্য সঙ্কটের আকার নিয়েছে।

শিশুদের প্রতি বিপদের সংকেত

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) ও ইউনিসেফের মতে, শিশুদের অপুষ্টি মানে শুধু ওজন কমে যাওয়া নয়, এটি তাদের মানসিক ও শারীরিক বিকাশকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করে। গাজার ৭০ হাজার শিশুর অপুষ্টি নির্ধারণের খবর উদ্বেগজনক।

এই শিশুদের জন্য প্রয়োজন অতি দ্রুত পুষ্টিকর খাদ্য ও স্বাস্থ্যসেবা।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের করণীয়

গাজার সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অবিলম্বে সক্রিয় পদক্ষেপের আহ্বান জানানো হচ্ছে। শুধু মানবিক সহায়তা নয়, রাজনৈতিক সমাধানও জরুরি। সংঘাত বন্ধ করে অবরোধ তুলে দেওয়া, ত্রাণ সরবরাহে বাধা অপসারণ করতে হবে।

দীর্ঘমেয়াদি শান্তি প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে গাজার মানুষদের জীবনযাত্রার উন্নয়ন ও মানবিক পরিস্থিতি উন্নত করা সম্ভব।

গাজার শিশু থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ ও জাতিসংঘের কর্মীরা আজ একটি ভয়াবহ অপুষ্টি ও খাদ্য সংকটের কবলে। আন্তর্জাতিক সহায়তা ও দ্রুত মানবিক পদক্ষেপ ছাড়া গাজার এই মানবিক বিপর্যয় অব্যাহত থাকবে।

সত্যিকারের শান্তি ও স্থিতিশীলতা ছাড়া গাজা কখনই স্বাভাবিক জীবন ফিরে পাবে না।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button