একনেকে ৮ হাজার ৩৩৩ কোটি টাকার ১৩ প্রকল্প অনুমোদন

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) ২০২৫ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর রাজধানীর আগারগাঁওয়ে অনুষ্ঠিত সভায় মোট ৮ হাজার ৩৩৩ কোটি ২৮ লাখ টাকার ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এই প্রকল্পগুলো দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে বিশেষ অবদান রাখবে। অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে নারী ক্ষমতায়ন, শিক্ষা, বিদ্যুৎ, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, বস্ত্র ও পাট, স্থানীয় সরকার, বিমান ও আবাসন খাতের উন্নয়নসহ বিভিন্ন খাতের প্রকল্প।
একনেক সভার সার্বিক চিত্র
সভায় সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ও একনেক চেয়ারম্যান ড. মুহাম্মদ ইউনুস। উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহ উদ্দিন আহমেদ, স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী (অব.), পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক উপদেষ্টা ফারুক ই আজম, শিক্ষা উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. চৌধুরী রফিকুল আবরার, শিল্প উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, জ্বালানি উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান প্রমুখ।
সভায় নতুন প্রকল্প অনুমোদনের পাশাপাশি কিছু সংশোধিত প্রকল্প ও মেয়াদ বৃদ্ধি সংক্রান্ত প্রস্তাবও গৃহীত হয়। অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর মধ্যে ৭টি নতুন প্রকল্প, ৫টি সংশোধিত প্রকল্প এবং ১টি মেয়াদ বৃদ্ধি প্রকল্প রয়েছে।
অর্থায়নের উৎস ও পরিমাণ
- সরকারি তহবিল: ৪,৪৩৭ কোটি ৮২ লাখ টাকা
- প্রকল্প ঋণ: ১,২২৫ কোটি ৩৬ লাখ টাকা
- নিজস্ব অর্থায়ন: ২,৬৭০ কোটি ০৯ লাখ টাকা
মোট ব্যয়: প্রায় ৮,৩৩৩ কোটি ২৮ লাখ টাকা।
অনুমোদিত প্রকল্পগুলোর বিস্তারিত
১. নারী ক্ষমতায়ন প্রকল্প
প্রকল্পের নাম: তথ্য আপা: তথ্য যোগাযোগ প্রযুক্তির মাধ্যমে নারীদের ক্ষমতায়ন প্রকল্প (দ্বিতীয় পর্যায়, তৃতীয় সংশোধিত)
বাস্তবায়ন: মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়
বিস্তারিত:
এই প্রকল্পের মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের নারীদের ডিজিটাল প্রযুক্তির সুবিধা পৌঁছে দেওয়া হবে। নারীদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তোলা, শিক্ষা ও কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি এবং অনলাইনে সরকারি সেবা গ্রহণের সুযোগ তৈরি করা হবে। ডিজিটাল বিভাজন কমিয়ে নারীদের সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থান শক্তিশালী করা হবে।
সম্ভাব্য প্রভাব:
- নারীদের অর্থনৈতিক স্বাবলম্বিতা বৃদ্ধি
- ডিজিটাল সাক্ষরতার উন্নয়ন
- কর্মসংস্থানের নতুন সুযোগ সৃষ্টি
২. শিক্ষা খাতের উন্নয়ন
প্রকল্পের নাম: ঢাকা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (ডুয়েট)-এর গবেষণাগার আধুনিকায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন
বাস্তবায়ন: শিক্ষা মন্ত্রণালয়
বিস্তারিত:
গবেষণাগার আধুনিকায়নের মাধ্যমে উচ্চশিক্ষায় গবেষণার মান বৃদ্ধি পাবে। প্রকৌশল শিক্ষার্থীরা আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষা গ্রহণে সক্ষম হবেন, যা দেশের প্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে সহায়ক হবে।
সম্ভাব্য প্রভাব:
- গবেষণার গুণগত মান বৃদ্ধি
- প্রযুক্তি উদ্ভাবনে সহায়তা
- শিক্ষার্থীদের দক্ষতা উন্নয়ন
৩. বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পসমূহ
- ২০০০ হর্স পাওয়ার রিগ ক্রয় প্রকল্প: আধুনিক রিগ সংগ্রহ করে গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদন বাড়ানো হবে।
- শাহবাজপুর ও ভোলা এলাকায় নতুন কূপ খনন প্রকল্প: ৪টি নতুন কূপ খনন ও অনুসন্ধান কূপ নির্মাণ।
- নেসকো এলাকায় বিদ্যুৎ বিতরণ আধুনিকায়ন প্রকল্প: নর্দান ইলেকট্রিসিটি সাপ্লাই কোম্পানির বিদ্যুৎ নেটওয়ার্ক উন্নয়ন ও আধুনিকায়ন।
সম্ভাব্য প্রভাব:
- গ্যাস উৎপাদন বৃদ্ধি
- বিদ্যুৎ সরবরাহের নির্ভরযোগ্যতা ও গুণগত মান উন্নয়ন
- বিদ্যুৎ বিভ্রাট কমানো
৪. রপ্তানি প্রতিযোগিতা বাড়াতে প্রকল্প
প্রকল্পের নাম: এক্সপোর্ট কম্পিটিটিভনেস ফর জবস (EC4J) (তৃতীয় সংশোধিত)
বাস্তবায়ন: বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
বিস্তারিত:
বাংলাদেশি পণ্যের আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টি এবং রপ্তানি আয় বৃদ্ধি করা হবে।
সম্ভাব্য প্রভাব:
- বৈদেশিক মুদ্রা আয় বৃদ্ধি
- রপ্তানিমুখী শিল্পের উন্নয়ন
- কর্মসংস্থানের সুযোগ বৃদ্ধি
৫. দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ প্রকল্প
প্রকল্পের নাম: উপকূলীয় ও ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকায় বহুমুখী ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ (তৃতীয় পর্যায়)
বিস্তারিত:
নতুন আশ্রয়কেন্দ্র নির্মাণ ও পুরনো কেন্দ্র সংস্কার করা হবে। উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
সম্ভাব্য প্রভাব:
- দুর্যোগে প্রাণহানি ও সম্পদের ক্ষতি কমানো
- স্থানীয় জনগণের নিরাপত্তা বৃদ্ধি
- দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় সক্ষমতা বৃদ্ধি
৬. বস্ত্র ও পাট খাতের উন্নয়ন
প্রকল্পসমূহ:
- শেখ হাসিনা স্পেশালাইজড জুট টেক্সটাইল মিল (প্রথম সংশোধিত)
- যমুনা স্পেশালাইজড জুট অ্যান্ড টেক্সটাইল মিল (প্রথম সংশোধিত)
বিস্তারিত:
দেশের ঐতিহ্যবাহী পাটশিল্পকে আধুনিকায়ন ও আন্তর্জাতিক বাজারে পাটজাত পণ্যের চাহিদা বাড়ানো হবে।
সম্ভাব্য প্রভাব:
- পাটশিল্পের উৎপাদন ও গুণগত মান বৃদ্ধি
- রপ্তানি আয় বৃদ্ধি
- গ্রামীণ অর্থনীতির উন্নয়ন
৭. স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের প্রকল্পসমূহ
- খুলনা পানি সরবরাহ প্রকল্প (ফেজ-২): খুলনার নাগরিকদের জন্য বিশুদ্ধ পানি সরবরাহ নিশ্চিত করা হবে।
- নারায়ণগঞ্জ সিটি কর্পোরেশনের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্প (প্রথম সংশোধিত): আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কেন্দ্র গড়ে তোলা হবে।
- মিয়ানমার থেকে আসা বাস্তুচ্যুত মানুষ ও স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প: রোহিঙ্গা ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে বিভিন্ন সেবা কার্যক্রম গ্রহণ করা হবে।
সম্ভাব্য প্রভাব:
- নগর জীবনের মান উন্নয়ন
- পরিবেশ সুরক্ষা ও স্বাস্থ্যকর পরিবেশ সৃষ্টি
- বাস্তুচ্যুত মানুষের পুনর্বাসন ও সহায়তা
৮. বিমান ও আবাসন খাতের উন্নয়ন
- সিলেট ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর সম্প্রসারণ প্রকল্প (প্রথম পর্যায়): নতুন টার্মিনাল ভবন, রানওয়ে সম্প্রসারণ ও যাত্রী সেবার মান উন্নয়ন।
- ঢাকার মিরপুর পাইকপাড়ায় সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য বহুতল আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প।
সম্ভাব্য প্রভাব:
- আঞ্চলিক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন
- যাত্রী সেবার মান বৃদ্ধি
- সরকারি কর্মচারীদের আবাসনের সমস্যা সমাধান
জাতীয় উন্নয়ন কৌশলে প্রকল্পগুলোর গুরুত্ব
- অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি: বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে।
- সামাজিক উন্নয়ন: নারী ক্ষমতায়ন, শিক্ষা ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে সামাজিক নিরাপত্তা ও জীবনমান উন্নত হবে।
- পরিবেশ ও টেকসই উন্নয়ন: বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ সংরক্ষণ প্রকল্প দেশের টেকসই উন্নয়নে সহায়ক হবে।
- আঞ্চলিক ও বৈদেশিক সম্পর্ক: বিমানবন্দর সম্প্রসারণ ও রপ্তানি খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে আঞ্চলিক ও বৈদেশিক বাণিজ্য বৃদ্ধি পাবে।
একনেকের এই ১৩টি প্রকল্প দেশের অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়নে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করবে। সরকারি তহবিল, ঋণ ও নিজস্ব অর্থায়নের সমন্বয়ে বাস্তবায়িত এই প্রকল্পগুলো দেশের স্থিতিশীলতা, কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বিশেষ করে নারী ক্ষমতায়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও অবকাঠামো উন্নয়নের মাধ্যমে দেশের সার্বিক উন্নয়ন নিশ্চিত হবে।
MAH – 12873 Signalbd.com