অর্থনীতি

“এক কেজি ইলিশ ২২০০ টাকা: ভরা মৌসুমেও কেন কমছে না দাম?”

ইলিশ মাছের দাম আকাশছোঁয়া

বাংলাদেশের জাতীয় মাছ ইলিশকে ঘিরে মানুষের আবেগ ও আগ্রহ সবসময়ই বিশেষ। ভরা মৌসুমেও এবার বাজারে ইলিশের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে থেকে গেছে। রাজধানীর মোহাম্মদপুর টাউন হল মার্কেটসহ ঢাকার বিভিন্ন খুচরা ও পাইকারি বাজার ঘুরে দেখা গেছে, ইলিশ মাছের আকারভেদে প্রতি কেজি ১৫০০ থেকে ৩৯০০ টাকার মধ্যে বিক্রি হচ্ছে।

১ কেজি ওজনের ইলিশ কিনতে ক্রেতাদের গুনতে হচ্ছে অন্তত ২২০০ টাকা। যদিও গত সপ্তাহে একই আকারের মাছ বিক্রি হয়েছিল ২৪০০ টাকায়, বর্তমানে তা কিছুটা কমে ২২০০ টাকা হলেও দাম এখনো মানুষের জন্য চড়া বলেই মনে করছেন ক্রেতারা।

সুপারশপেও বাড়তি দাম

শুধু স্থানীয় বাজার নয়, দেশের বড় বড় সুপারশপগুলোতেও ইলিশের দাম বাড়ছে। যেমন—

  • সুপারশপ স্বপ্নে ৯০০ গ্রামের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে ২১৬০ টাকায়, ১-১.২ কেজি ওজনের ইলিশ ২৩৯৫ টাকায়।
  • মিনা বাজারে একই ওজনের মাছের দাম আরও বেশি—২৮৮২ টাকা।
  • চালঢালে অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ৪০০ গ্রামের ইলিশ ৫৫৯ টাকা, ১ কেজি ইলিশ ২৬৯৯ টাকা, আর ১.১ কেজির বেশি ওজনের ইলিশ ৩০১৯ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।
  • ইউনিমার্টে দাম আরও বৈচিত্র্যময়—৫০০-৬০০ গ্রামের ইলিশ ৯৯৯ টাকা থেকে শুরু করে ২ কেজি ওজনের ইলিশ বিক্রি হচ্ছে প্রায় ৪০০০ টাকায়।

ভোক্তাদের অভিযোগ

বাজারে ইলিশ কিনতে আসা অনেকেই বলছেন, ভরা মৌসুমেও এমন দাম কোনোভাবেই ন্যায্য নয়। আগে পরিবার নিয়ে ৩-৪টি ইলিশ কিনলেও এখন একটিই কিনতে হিমশিম খেতে হচ্ছে।

ঢাকার শ্যামলী থেকে মাছ কিনতে আসা গৃহিণী সাদিয়া আক্তার বলেন,

“ইলিশ ছাড়া উৎসবের আনন্দই নেই। কিন্তু এই দামে সাধারণ মানুষের জন্য ইলিশ কেনা দুঃস্বপ্নের মতো।”

ব্যবসায়ীদের বক্তব্য

মোহাম্মদপুরের মাছ ব্যবসায়ী আকরাম জানান,

“আমরা ইচ্ছা করে দাম বাড়াচ্ছি না। জেলেদের জালে মাছ খুব একটা পড়ছে না। পদ্মা, চাঁদপুর ও চট্টগ্রামের ইলিশের দামে পার্থক্য রয়েছে। মাছ কম ধরা পড়ায় দাম বেশি। এক কেজি ইলিশ ২০০০ টাকার নিচে পাওয়া এখন প্রায় অসম্ভব।”

তিনি আরও বলেন,

“আমরা প্রতি কেজিতে ১০০-১৫০ টাকার বেশি লাভ করি না। বাজারে দাম বেড়ে গেলে আমাদেরও দাম বাড়াতে হয়।”

কেন ইলিশের দাম এত বেশি?

১. মাছের ঘাটতি: জেলেদের জালে ইলিশ কম ধরা পড়ছে।
২. আবহাওয়ার প্রভাব: এ বছর পদ্মা-মেঘনা নদীতে পানির স্রোত ও আবহাওয়া অনুকূলে না থাকায় মাছ কম এসেছে।
৩. চাহিদা বেশি: পূজা ও উৎসবকে কেন্দ্র করে ইলিশের চাহিদা বাড়ে, ফলে দামও চড়া হয়।
৪. রপ্তানি প্রভাব: বাংলাদেশ থেকে ইলিশ রপ্তানি হয় প্রতিবেশী দেশ ভারতে। এতে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ কমে যায়।
৫. জ্বালানি খরচ: মাছ ধরা ও পরিবহনে জ্বালানি খরচ বাড়ায় এর প্রভাব দামেও পড়ছে।

ভোক্তাদের ক্ষোভ

ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের সংগঠনগুলো বলছে, সরকারের কঠোর নজরদারি ছাড়া ইলিশের দাম কমানো সম্ভব নয়। বাজারে দালাল ও আড়তদারদের প্রভাবের কারণে ক্রেতাদের সর্বাধিক ক্ষতি হচ্ছে।

একজন ভোক্তা অধিকার কর্মী বলেন,

“ইলিশ শুধু মাছ নয়, এটি আমাদের সংস্কৃতির অংশ। অথচ এখন ইলিশ কিনতে গেলে অনেক পরিবারকে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। সরকার চাইলে রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ ও বাজার মনিটরিং করে দাম নিয়ন্ত্রণে আনতে পারে।”

ঐতিহাসিক দৃষ্টিকোণ

কয়েক বছর আগেও ভরা মৌসুমে ১ কেজি ইলিশের দাম ছিল ৮০০-১২০০ টাকার মধ্যে। অথচ এখন সেই একই মাছের দাম দ্বিগুণ বা তিনগুণ বেড়ে গেছে।

২০১৯ সালে ভরা মৌসুমে ১ কেজি ইলিশ বিক্রি হয়েছিল গড়ে ১২০০ টাকায়। ২০২৫ সালে এসে সেই দাম দাঁড়িয়েছে প্রায় ২০০০-৩৫০০ টাকায়।

সরকারের পদক্ষেপ

সরকারি তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রতিবছর প্রায় ৬ লাখ মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন হয়। এর মধ্যে বড় একটি অংশ রপ্তানি হয়। সরকার জাটকা নিধন বন্ধে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। কিন্তু সঠিক সময়ে সঠিক পরিমাণ ইলিশ বাজারে না আসায় দাম নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না।

মৎস্য অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা জানিয়েছেন,

“এ বছর নদীতে পানির প্রবাহে সমস্যা হওয়ায় ইলিশ কম ধরা পড়ছে। তবে আগামী মাসে পরিস্থিতি কিছুটা স্বাভাবিক হতে পারে।”

ইলিশ ও বাঙালির সংস্কৃতি

ইলিশ শুধু একটি মাছ নয়, এটি বাঙালি সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। দুর্গাপূজা হোক বা নববর্ষ, ইলিশ ছাড়া যেন উৎসবই অসম্পূর্ণ। অথচ দামের কারণে এখন অনেকেই সেই স্বাদ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।

ইলিশ বাংলাদেশের জাতীয় মাছ। ভরা মৌসুমেও যদি সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়, তবে সেটি শুধু বাজারের ব্যর্থতা নয়, বরং সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গেও বেইমানি। দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে সরকারকে বাজার ব্যবস্থাপনায় আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।

MAH – 12767,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button