ঢাকা: সাম্প্রতিক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, আগস্ট ২০২৫ মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে পাঠিয়েছেন ২৪২ কোটি ২০ লাখ মার্কিন ডলার, যা প্রায় ২৯,৫৪৮ কোটি টাকার সমতুল্য (প্রতি ডলার ১২২ টাকা হিসাবে)। এই তথ্য মঙ্গলবার (১ সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, এই রেমিট্যান্স দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। বিশেষ করে ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠানোর অভ্যাস বাড়ার ফলে হুন্ডি লেনদেনের প্রবণতা কমেছে। সরকার ও ব্যাংকিং প্রতিষ্ঠানের উদ্যোগ, প্রণোদনা এবং ডিজিটাল ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নয়নের ফলে প্রবাসীদের পাঠানো অর্থের ধারাবাহিকতা বজায় আছে।
রেমিট্যান্স প্রবাহের ধারাবাহিকতা
গত জুলাই ২০২৫ মাসে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে পাঠিয়েছিলেন ২৪৮ কোটি মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় প্রায় ৩০,২৩0 কোটি টাকা। অর্থাৎ আগস্ট মাসে সামান্য কম হলেও প্রায় একই স্তরে রেমিট্যান্স প্রবাহ অব্যাহত আছে।
চলতি অর্থবছর ২০২৫-২৬ সালের প্রথম দুই মাসে (জুলাই ও আগস্ট) দেশে রেমিট্যান্স এসেছে ৪৯০ কোটি মার্কিন ডলার, যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৮ শতাংশ বৃদ্ধি (গত বছর একই সময়ে ৪১৪ কোটি ডলার এসেছে)।
রেমিট্যান্স বৃদ্ধি এবং দেশের অর্থনীতি
বাংলাদেশে প্রবাসী আয়ের ধারাবাহিক বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা, বৈদেশিক মুদ্রার যোগান এবং ডলারের জোগানের স্বস্তি নিশ্চিত করছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ তথ্য অনুযায়ী:
- ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে পাঠিয়েছেন ৩০.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি।
- ২০২৩-২৪ অর্থবছরে দেশে এসেছে ২৩.৭৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা তখনকার রেকর্ড হিসেবে ধরা হয়।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রবাসী আয়ের ধারাবাহিক বৃদ্ধির ফলে দেশের মুদ্রানীতি, ব্যাংকিং খাত এবং বিনিয়োগের পরিবেশ আরও শক্তিশালী হচ্ছে। এছাড়াও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সহায়ক হচ্ছে।
প্রবাসীদের রেমিট্যান্স: হুন্ডি লেনদেন হ্রাসে কার্যকর ভূমিকা
বাংলাদেশে হুন্ডি লেনদেন কমানোর জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। এর মধ্যে প্রধান হলো:
- বিনামূল্যে বা কম খরচে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ বৃদ্ধি।
- ডিজিটাল এবং মোবাইল ব্যাংকিং ব্যবস্থার উন্নয়ন।
- প্রবাসী বন্ধু প্রকল্প এবং প্রণোদনা, যা প্রবাসীদের উৎসাহিত করছে বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠাতে।
ফলস্বরূপ, প্রবাসীরা ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে তাদের আয় পাঠাতে বেশি আগ্রহী হচ্ছেন। ব্যাংক কর্মকর্তারা বলেন, এই ধরনের প্রণোদনা ও সেবা বৃদ্ধির ফলে বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহে ধারাবাহিকতা তৈরি হয়েছে।
রেমিট্যান্সের অর্থনৈতিক প্রভাব
প্রবাসী রেমিট্যান্সের দেশের অর্থনীতিতে বহু প্রভাব রয়েছে:
- বৈদেশিক মুদ্রার যোগান বাড়ানো।
- ডলারের অভাবে মুদ্রাস্ফীতি বা মূল্যস্ফীতি প্রতিরোধে সহায়ক।
- গৃহস্থালির খরচ এবং বিনিয়োগ বাড়াতে সাহায্য।
- ছোট ও মাঝারি ব্যবসায় (SME) খাতে ঋণ এবং বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রা সরবরাহ।
অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, প্রবাসী আয়ের ধারাবাহিক প্রবাহ দেশের মুদ্রানীতি, বাজার স্থিতিশীলতা এবং বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
রেকর্ড রেমিট্যান্সের পেছনের কারণ
বাংলাদেশে রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক বৃদ্ধি ঘটে বিভিন্ন কারণে:
- প্রবাসীদের আয়ের বৃদ্ধি: মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ এবং আমেরিকায় প্রবাসী বাংলাদেশিরা ভাল আয় করছেন।
- ডিজিটাল ব্যাংকিং সুবিধা: সহজ, দ্রুত এবং কম খরচে অর্থ পাঠানোর সুবিধা।
- সরকারি প্রণোদনা: বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠানোর জন্য নগদ পুরস্কার, সুদের সুবিধা ইত্যাদি।
- হুন্ডি প্রতিরোধ: বৈধ চ্যানেলের মাধ্যমে অর্থ পাঠানো আরও সুবিধাজনক হওয়ায় প্রবাসীরা হুন্ডি লেনদেন কম করছেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই ধারাবাহিকতা যদি বজায় থাকে, তবে আগামী বছরগুলিতে রেমিট্যান্স আরও বৃদ্ধি পাবে এবং দেশের বিনিয়োগ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত হবে।
আন্তর্জাতিক তুলনা
দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশগুলোর সাথে তুলনা করলে দেখা যায়, বাংলাদেশের প্রবাসী রেমিট্যান্সের প্রবাহ বেশ উল্লেখযোগ্য। উদাহরণস্বরূপ:
- ভারত: প্রতি বছর প্রায় ৮০-৯০ বিলিয়ন ডলার।
- পাকিস্তান: প্রায় ৩৩-৩৫ বিলিয়ন ডলার।
- শ্রীলঙ্কা: প্রায় ৭-৮ বিলিয়ন ডলার।
বাংলাদেশের প্রবাসী রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি দেশের অর্থনৈতিক মর্যাদা এবং বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভের দৃঢ়তা প্রমাণ করে।
আগামী দিনের প্রেক্ষাপট
অর্থনীতিবিদরা আশা করছেন, ২০২৫-২৬ অর্থবছরের শেষ নাগাদ রেমিট্যান্সের প্রবাহ আরও বৃদ্ধি পাবে, কারণ:
- বিদেশে প্রবাসীদের সংখ্যা এবং আয় বৃদ্ধি।
- বৈধ চ্যানেলে অর্থ পাঠানোর সুবিধা ও প্রণোদনা।
- দেশের বিনিয়োগ ও উন্নয়ন প্রকল্পে প্রবাসী বিনিয়োগ আকর্ষণ।
এছাড়াও, রেমিট্যান্সের ধারাবাহিক প্রবাহ দেশের মুদ্রানীতি, বিনিয়োগের পরিবেশ এবং অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে গুরুত্বপূর্ণ।
আগস্ট ২০২৫ মাসে প্রবাসী রেমিট্যান্সে আসা ২৪২ কোটি ডলার শুধুমাত্র অর্থনৈতিক সংখ্যা নয়। এটি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি, অর্থনীতির স্থিতিশীলতা, হুন্ডি লেনদেন হ্রাস এবং বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নয়ন নির্দেশ করে।
বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের প্রচেষ্টা, প্রবাসী মানুষের সমর্থন এবং প্রযুক্তি ব্যবহার মিলিয়ে এই প্রবাহ অব্যাহত থাকবে বলে বিশ্লেষকরা আশা করছেন। প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের অর্থনীতির জন্য এখন অনন্য উৎস হিসেবে কাজ করছে এবং আগামী দিনে আরও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
MAH – 12596, Signalbd.com



