অর্থনীতি

বছরের প্রথম পাঁচ মাসে আমানত বৃদ্ধিতে এগিয়ে ব্র্যাক, ইসলামী ও ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংক

বাংলাদেশের ব্যাংক খাতে চলছে আমানতের নতুন প্রতিযোগিতা। দেশের অনেক ব্যাংক যখন তারল্য সংকটে ভুগছে, গ্রাহকের টাকা ফেরত দিতে হিমশিম খাচ্ছে, তখন ব্র্যাক ব্যাংক, ইসলামী ব্যাংক ও ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংকের মতো প্রতিষ্ঠিত ব্যাংকগুলোতে আমানতের জোয়ার দেখা যাচ্ছে। গ্রাহকের আস্থা, প্রযুক্তিনির্ভর সেবা এবং পেশাদারিত্ব—সব মিলিয়ে এগুলোই এখন আমানত বৃদ্ধির মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে।

সুদের হার বৃদ্ধির প্রভাব

২০২৪ সালের মাঝামাঝি সময় থেকে বাংলাদেশ ব্যাংক আমানতের সুদহার নিয়ন্ত্রণ তুলে দেয়। এর ফলে ব্যাংকগুলো স্বাধীনভাবে সুদের হার নির্ধারণ করতে শুরু করে। যদিও ঋণের চাহিদা এখনো কম, আর সরকারি ট্রেজারি বিল ও বন্ডের সুদহারও নিম্নমুখী, তারপরও ভালো ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত সুদ না বাড়িয়েও গ্রাহকের আমানত আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে। কারণ, মানুষ ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাংকের পরিবর্তে নিরাপদ ব্যাংকেই টাকা রাখতে চাইছেন।

অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) চেয়ারম্যান এবং সিটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মাসরুর আরেফিন বলেন,

“যেসব ব্যাংক প্রশ্নবিদ্ধ বা সংকটে পড়েছে, সেখান থেকে গ্রাহকেরা নিরাপদ ব্যাংকের দিকে চলে আসছেন। আস্থা ও বিশ্বাসই এখন আমানত বৃদ্ধির সবচেয়ে বড় কারণ।”

শীর্ষে ব্র্যাক ব্যাংক

২০২৫ সালের জানুয়ারি থেকে মে—এই পাঁচ মাসে সর্বোচ্চ আমানত বেড়েছে ব্র্যাক ব্যাংকে।

  • ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে ব্র্যাক ব্যাংকের মোট আমানত ছিল ৭০ হাজার ৪২৫ কোটি টাকা
  • ২০২৫ সালের মে মাসে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮ হাজার ৫৪৯ কোটি টাকা
  • অর্থাৎ, মাত্র পাঁচ মাসে ৮ হাজার ১২৪ কোটি টাকা নতুন আমানত এসেছে।

ব্যাংকের এমডি (চলতি দায়িত্বে) তারেক রেফাত উল্লাহ খান বলেন,

“ব্র্যাক ব্যাংক সব সময়ই আস্থার জায়গায় রয়েছে। আমরা শাখা, উপশাখা ও এজেন্ট ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে সারা দেশে সেবা ছড়িয়ে দিয়েছি। গ্রাহকেরা শুধু আমানতই রাখছেন না, রেমিট্যান্স সেবাতেও আমাদের বেছে নিচ্ছেন। আন্তর্জাতিক রেটিং সংস্থাগুলোর কাছ থেকেও আমরা ইতিবাচক মূল্যায়ন পেয়েছি। সব মিলিয়ে এটাই আমাদের প্রবৃদ্ধির মূল রহস্য।”

ইসলামী ব্যাংক: আস্থা ফিরে পাওয়ার গল্প

আমানত বৃদ্ধির তালিকায় দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে ইসলামী ব্যাংক।

  • গত বছরের ডিসেম্বরে ব্যাংকটির আমানত ছিল ১ লাখ ৫৮ হাজার ৪৩৫ কোটি টাকা
  • এ বছরের মে মাসে বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ লাখ ৬৬ হাজার ২১৭ কোটি টাকা
  • অর্থাৎ পাঁচ মাসে বেড়েছে প্রায় ৭ হাজার ৭৮২ কোটি টাকা

তবে ইসলামী ব্যাংক দীর্ঘদিন ধরে বড় অঙ্কের খেলাপি ঋণের সমস্যায় ভুগছে। এসব ঋণের বড় অংশ আটকা পড়েছে এস আলম গ্রুপসহ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কাছে। সরকার পরিবর্তনের পর ব্যাংকটির ওপর থেকে রাজনৈতিক প্রভাব কিছুটা কমেছে।

ব্যাংকের এমডি ওমর ফারুক খান বলেন,

“গ্রাহকের আস্থা ফিরেছে। অনিয়ম বন্ধ হয়েছে, ফলে মানুষ আবার ইসলামী ব্যাংকে টাকা জমা রাখছেন। আমরা ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের বড় অংশ শোধ করেছি এবং খেলাপি ঋণ আদায়ের প্রক্রিয়াও শুরু করেছি।”

ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংক: প্রযুক্তির কারণে শীর্ষে

তৃতীয় স্থানে রয়েছে ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংক লিমিটেড (ডিবিবিএল)।

  • ২০২৪ সালের ডিসেম্বরে আমানত ছিল ৫২ হাজার ৫৮৮ কোটি টাকা
  • ২০২৫ সালের মে মাসে বেড়ে দাঁড়ায় ৫৯ হাজার ৪৮৮ কোটি টাকা
  • অর্থাৎ আমানত বেড়েছে ৬ হাজার ৮৬০ কোটি টাকা

ডিবিবিএলের এমডি আবুল কাশেম মো. শিরিন বলেন,

“আমরা গত বছর সাড়ে ৩০০ নতুন উপশাখা খুলেছি। এজেন্ট ব্যাংকিং ও ডিজিটাল সেবার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে পৌঁছে গেছি। মানুষ আমাদের প্রতি আস্থা রাখছে, তাই স্বাভাবিকভাবেই আমানত বাড়ছে।”

অন্যান্য ব্যাংকের প্রবৃদ্ধি

শীর্ষ তিন ব্যাংকের পাশাপাশি আরও কয়েকটি ব্যাংক উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি দেখিয়েছে।

  • ইউনাইটেড কমার্শিয়াল ব্যাংক (ইউসিবি):
    আমানত বেড়েছে ৫৭ হাজার ৪১২ কোটি টাকা থেকে ৬০ হাজার ৭৩৮ কোটি টাকায়। খুচরা গ্রাহকেরা ৫৬% নতুন আমানত রেখেছেন।
  • পূবালী ব্যাংক:
    আমানত বেড়েছে ৭০ হাজার ৬৩৭ কোটি টাকা থেকে ৭৪ হাজার ৬৩২ কোটি টাকা।
  • সিটি ব্যাংক:
    ৪৫ হাজার ৯৭০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৪৯ হাজার ৬০১ কোটি টাকা।
  • আইএফআইসি ব্যাংক:
    ৪৮ হাজার ২৭৮ কোটি টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ৫০ হাজার ৯০৩ কোটি টাকা।
  • যমুনা ব্যাংক:
    ২৯ হাজার ৯৪৬ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ৩২ হাজার ৫৯ কোটি টাকা।
  • ব্যাংক এশিয়া:
    ৩৮ হাজার ৪১৩ কোটি থেকে বেড়ে ৪০ হাজার ২০৭ কোটি টাকা।
  • ঢাকা ব্যাংক:
    ২৮ হাজার ৩২০ কোটি টাকা থেকে বেড়ে ২৯ হাজার ৯৯০ কোটি টাকা।

এ ছাড়া এবি ব্যাংক, ট্রাস্ট ব্যাংক, শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংক, ইস্টার্ন ব্যাংক, মিডল্যান্ড ব্যাংকসহ আরও বেশ কয়েকটি ব্যাংকের আমানত বেড়েছে।

কেন কিছু ব্যাংকে টাকা বাড়ছে?

অর্থনীতিবিদদের মতে, এর কয়েকটি প্রধান কারণ হলো—

  1. গ্রাহকের আস্থা: দীর্ঘমেয়াদে ভালো রেপুটেশন থাকা ব্যাংকগুলোতে মানুষ বেশি টাকা রাখছে।
  2. রাজনৈতিক পরিবর্তন: কিছু ব্যাংক সরকার বদলের পর রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত হয়েছে, ফলে গ্রাহকের আস্থা ফিরেছে।
  3. ডিজিটাল ব্যাংকিং: এজেন্ট ব্যাংকিং, মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইন লেনদেনের কারণে গ্রাহকের কাছে সহজলভ্য হয়েছে।
  4. বিদেশি রেমিট্যান্স: ব্র্যাক ও ডাচ্‌–বাংলা ব্যাংকের মতো ব্যাংকগুলো প্রবাসীদের রেমিট্যান্স আনার ক্ষেত্রে বিশেষ সেবা দিচ্ছে।

সামনে কী অপেক্ষা করছে?

যদিও ব্যাংকগুলোতে আমানত বাড়ছে, কিন্তু ঋণের চাহিদা এখনো আশানুরূপ বাড়েনি। শিল্প-কারখানা ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন বিনিয়োগ ধীর গতিতে এগোচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলো বাড়তি টাকা ব্যবহার করতে পারছে না।

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা মনে করছেন, যদি ঋণ বিতরণ বাড়ানো না যায়, তাহলে ব্যাংকগুলো অতিরিক্ত আমানত ধরে রাখতে সমস্যায় পড়তে পারে। তবে ভালো ব্যাংকগুলো এখন গ্রাহকের আস্থা অর্জনের দৌড়ে এগিয়ে আছে, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের জন্য ইতিবাচক হবে।

MAH – 12375 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button