অর্থনীতি

একনেকে অনুমোদন ১১ প্রকল্পে ব্যয় ৯৩৬১ কোটি টাকা

Advertisement

একনেকের বৈঠকে ১১টি নতুন প্রকল্প অনুমোদন

জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটি (একনেক) দেশের উন্নয়ন কার্যক্রমকে আরও গতিশীল করতে নতুন করে ১১টি প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছে। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে মোট ব্যয় হবে ৯ হাজার ৩৬১ কোটি ৯২ লাখ টাকা

২০২৫ সালের ১৭ আগস্ট রবিবার, রাজধানীর শেরে বাংলা নগরের এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত বৈঠকে এই অনুমোদন দেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন প্রধান উপদেষ্টা ও একনেক চেয়ারপারসন ড. মুহাম্মদ ইউনূস

সভায় উপস্থিত ছিলেন পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল, স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, শিল্প ও গৃহায়ন উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান, বিদ্যুৎ, সড়ক ও রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, পানি ও পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানসহ সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা।

ব্যয়ের উৎস

পরিকল্পনা উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে জানানো হয়, মোট ৯,৩৬১ কোটি টাকার মধ্যে –

  • সরকারি অর্থায়ন: ৬,৬৭৭ কোটি টাকা
  • বৈদেশিক ঋণ: ২,৪২৮ কোটি ৪ লাখ টাকা
  • সংশ্লিষ্ট সংস্থার নিজস্ব অর্থায়ন: ২৫৬ কোটি ৮৯ লাখ টাকা

এর মধ্যে ৫টি নতুন প্রকল্প, ২টি সংশোধিত প্রকল্প এবং ৩টি প্রকল্পে মেয়াদ বৃদ্ধি (ব্যয় বৃদ্ধি ছাড়াই) অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।

অনুমোদিত ১১ প্রকল্পের বিস্তারিত

১. রংপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্প – আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে কৃষিতে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ও কৃষকদের সহায়তা।
২. ৩৩/১১ কেভি আউটডোর উপকেন্দ্র আধুনিকায়ন প্রকল্প – বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থার দক্ষতা বাড়াতে বিদ্যমান অবকাঠামো উন্নয়ন।
৩. কেরু অ্যান্ড কোং লিমিটেড (২য় সংশোধিত) প্রকল্প – রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন এই ঐতিহ্যবাহী চিনিকল ও শিল্পকারখানার আধুনিকায়ন।
৪. রবীন্দ্র বিশ্ববিদ্যালয় বাংলাদেশ স্থাপন প্রকল্প – সাংস্কৃতিক ও উচ্চশিক্ষা সম্প্রসারণের উদ্দেশ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামো উন্নয়ন।
৫. ৫টি মেডিকেল কলেজে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট স্থাপন – সিলেট, বরিশাল, রংপুর, রাজশাহী ও ফরিদপুরে বিশেষায়িত স্বাস্থ্যসেবা চালু করা।
৬. আজিমপুর সরকারি কলোনিতে বহুতল ফ্ল্যাট নির্মাণ প্রকল্প – সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য আবাসন সুবিধা বাড়ানো।
৭. ফায়ার সার্ভিস কর্মীদের জন্য আবাসন প্রকল্প – কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের জন্য ২টি বহুতল ভবন নির্মাণ।
৮. ঢাকা এনভায়রনমেন্টাল সাসটেনেবল ওয়াটার সাপ্লাই (৩য় সংশোধিত) – টেকসই পানির যোগান নিশ্চিত করা।
৯. বান্দরবান পৌরসভা ও পার্শ্ববর্তী এলাকায় নিরাপদ পানি ও স্যানিটেশন প্রকল্প (১ম সংশোধিত) – পাহাড়ি এলাকায় পানি ও স্যানিটেশনের মানোন্নয়ন।
১০. চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন – শিল্পাঞ্চলে ডিজিটাল সংযোগ ও ব্যবসায়িক অবকাঠামো উন্নয়ন।
১১. উপজেলা পর্যায়ে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ (২য় পর্যায়, সংশোধিত) – স্থানীয় ক্রীড়া অবকাঠামো শক্তিশালী করা।

কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তায় গুরুত্ব

রংপুর অঞ্চলে টেকসই কৃষি উন্নয়ন প্রকল্পকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। দেশের উত্তরাঞ্চলের কৃষকরা এখনও অনেকে প্রথাগত কৃষি পদ্ধতির ওপর নির্ভরশীল। এই প্রকল্প বাস্তবায়নের ফলে কৃষিতে আধুনিক যন্ত্রপাতি, সেচ প্রযুক্তি ও নতুন জাতের ফসলের ব্যবহার বাড়বে।

এটি কেবল কৃষকদের আয় বাড়াবে না, বরং জাতীয় খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতেও বড় ভূমিকা রাখবে।

স্বাস্থ্য খাতে বিনিয়োগ

সিলেট, বরিশাল, রংপুর, রাজশাহী এবং ফরিদপুর মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিট চালুর সিদ্ধান্তকে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা যুগান্তকারী হিসেবে দেখছেন।

বাংলাদেশে প্রতি বছর বিপুল সংখ্যক মানুষ অগ্নিদগ্ধ বা দুর্ঘটনায় গুরুতর দগ্ধ হন। ঢাকায় শেখ হাসিনা জাতীয় বার্ন ইনস্টিটিউট ছাড়া বড় কোনো বার্ন সেন্টার নেই। নতুন ইউনিটগুলো চালু হলে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ ঢাকায় না গিয়ে স্থানীয় পর্যায়ে চিকিৎসা পাবেন।

আবাসন ও নগর উন্নয়ন

আজিমপুর সরকারি কলোনি ও ফায়ার সার্ভিসের জন্য নতুন আবাসন প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে সরকারি কর্মচারীদের দীর্ঘদিনের আবাসন সংকট কিছুটা কমবে।

ঢাকার জনসংখ্যা ও আবাসনের চাপ কমাতে বহুতল ভবন নির্মাণকে সরকার অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে বিবেচনা করছে।

পরিবেশ ও পানি খাত

ঢাকা শহরের পানি সরবরাহ ব্যবস্থায় দীর্ঘদিন ধরে ঘাটতি রয়েছে। এনভায়রনমেন্টাল সাসটেনেবল ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে রাজধানীতে নিরাপদ ও দীর্ঘমেয়াদি পানির যোগান নিশ্চিত হবে।

অন্যদিকে বান্দরবানসহ পাহাড়ি এলাকায় পানি ও স্যানিটেশনের উন্নয়ন প্রকল্প স্থানীয় জনগণের জীবনমান উন্নয়নে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।

ক্রীড়া ও তরুণ সমাজ

উপজেলা পর্যায়ে মিনি স্টেডিয়াম নির্মাণ প্রকল্পটি দেশের তরুণ প্রজন্মকে ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করতে সহায়ক হবে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শুধু খেলোয়াড় তৈরিই করবে না, বরং যুব সমাজকে মাদক ও অসামাজিক কার্যকলাপ থেকে দূরে রাখতে বড় ভূমিকা রাখবে।

মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চল: শিল্প ও কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা

চট্টগ্রামের মিরসরাই অর্থনৈতিক অঞ্চলকে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ শিল্পাঞ্চল হিসেবে গড়ে তোলা হচ্ছে। এখানে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক স্থাপন প্রকল্প বিনিয়োগকারীদের জন্য অবকাঠামোগত সুবিধা বাড়াবে এবং স্থানীয়ভাবে নতুন কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে।

একনেকে উপস্থাপিত আরও ৯ প্রকল্প

এবারের বৈঠকে অনুমোদিত ১১টি প্রকল্প ছাড়াও পরিকল্পনা উপদেষ্টার কার্যালয় ইতোমধ্যে নিজস্ব ক্ষমতায় অনুমোদিত ৯টি প্রকল্প সম্পর্কে একনেক সদস্যদের অবহিত করেছে। এর মধ্যে রয়েছে—

  • হাতিয়া, নিঝুম ও কুতুবদিয়া দ্বীপে শতভাগ বিদ্যুতায়ন,
  • রাজশাহী ও রংপুরে স্মার্ট প্রি-পেমেন্ট মিটার স্থাপন,
  • বরগুনার পৌরসভায় অবকাঠামো উন্নয়ন,
  • পাহাড়ি এলাকায় দুর্যোগে ক্ষতিগ্রস্ত সড়ক উন্নয়ন,
  • লাঙ্গলবন্দ মহাষ্টমী পুণ্যস্নানের অবকাঠামো উন্নয়ন,
  • তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি,
  • সিলেট অঞ্চলের গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন,
  • কপোতাক্ষ নদে জলাবদ্ধতা নিরসন,
  • বিদ্যালয় বহির্ভূত কিশোর-কিশোরীদের দক্ষতা উন্নয়ন প্রকল্প।

সার্বিক বিশ্লেষণ

বিশেষজ্ঞদের মতে, এবারের একনেক অনুমোদিত প্রকল্পগুলো দেশের অর্থনীতি, কৃষি, স্বাস্থ্য, অবকাঠামো ও সামাজিক খাতে একটি ভারসাম্যপূর্ণ বিনিয়োগ নির্দেশ করছে।

  • কৃষি ও খাদ্য নিরাপত্তা জোরদার হবে।
  • স্বাস্থ্যখাতে অগ্নিদগ্ধ রোগীদের চিকিৎসা সহজ হবে।
  • আবাসন খাতে সরকারি কর্মচারীদের জীবনমান উন্নত হবে।
  • পানি ও পরিবেশ খাতে নিরাপদ পানির যোগান বাড়বে।
  • শিল্পাঞ্চলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থান বাড়বে।
  • ক্রীড়া অবকাঠামো তৈরি হবে, যা তরুণদের ইতিবাচক কাজে যুক্ত করবে।

সবমিলিয়ে, এই ১১ প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে দেশের সার্বিক উন্নয়ন আরও গতি পাবে বলে মনে করছেন পরিকল্পনাবিদ ও অর্থনীতিবিদরা।

MAH – 12370 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button