অর্থনীতি

এলএনজি আমদানিতে নতুন দিগন্ত: বিশ্বব্যাংকের ৩৫ কোটি ডলারের ঋণ গ্যারান্টি প্রস্তাব

তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির জন্য বাংলাদেশকে ৩৫ কোটি ডলার ঋণ গ্যারান্টির প্রস্তাব দিয়েছে বিশ্বব্যাংকের সহযোগী সংস্থা মাল্টিলেটারাল ইনভেস্টমেন্ট গ্যারান্টি এজেন্সি (মিগা)। বর্তমান বৈদেশিক অর্থায়নগুলোর তুলনায় এই প্রস্তাবের শর্ত অনেক সহজ। এতে দেশের দীর্ঘমেয়াদি এলএনজি আমদানির প্রয়োজন মেটানোর একটি নতুন সুযোগ তৈরি হবে।

বিশ্বব্যাংকের প্রস্তাব এবং সুবিধা

মিগার প্রস্তাবে বলা হয়েছে, পেট্রোবাংলা দেশি এবং বিদেশি ব্যাংকের মাধ্যমে ঋণপত্র (এলসি) খুলতে পারবে। এর ফলে সহজ এবং নিরাপদ উপায়ে এলএনজি সরবরাহ নিশ্চিত করা যাবে। প্রস্তাব অনুযায়ী, এলসি’র মেয়াদ হবে ৩ মাস এবং এই ঋণ পরিশোধের সময়সীমা থাকবে ৯ মাস।

এছাড়াও, বর্তমান আইটিএফসি থেকে নেওয়া ঋণের তুলনায় মিগার গ্যারান্টির সুদহার এক শতাংশ পয়েন্ট কম হবে। ফলে বাংলাদেশ আর্থিকভাবে লাভবান হবে এবং গ্যাসের সরবরাহ নিশ্চিত করতে দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম চালিয়ে যেতে পারবে।

পোশাকের পরিপ্রেক্ষিত

ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স কর্পোরেশন (আইটিএফসি) বর্তমানে বাংলাদেশের এলএনজি আমদানিতে ঋণ সরবরাহ করছে। তবে আইটিএফসি’র ঋণের শর্ত মিগার প্রস্তাবের তুলনায় কিছুটা কঠোর। আইটিএফসি ঋণে ছয় মাসের সোফর রেটের সাথে ১.৮০ শতাংশ সুদ এবং অতিরিক্ত শূন্য দশমিক ২ শতাংশ ফি রয়েছে। এর বিপরীতে, মিগার প্রস্তাবে সুদহার সোফর রেটের সাথে সর্বোচ্চ ১.০১ শতাংশ এবং গ্যারান্টি ফি শূন্য দশমিক ৩ শতাংশ নির্ধারণ করা হয়েছে।

সরকারের প্রতিক্রিয়া

বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেন, “মিগার প্রস্তাবটি ইতিবাচকভাবে বিবেচনা করা হচ্ছে। সুদের হার কম এবং ঋণ পরিশোধের মেয়াদ বেশি থাকায় এটি সরবরাহকারীদের পাওনা পরিশোধ সহজ করবে।”

এ বিষয়ে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) কাজ করছে। প্রস্তাব চূড়ান্ত করার আগে বিশ্বব্যাংকের কাছে গ্যারান্টি ফি এবং আপফ্রন্ট ফি কমানোর অনুরোধ করা হবে।

এলএনজি আমদানিতে নতুন সম্ভাবনা

বাংলাদেশে দৈনিক ৩৮০ কোটি ঘনফুট গ্যাসের চাহিদার বিপরীতে সরবরাহ করা সম্ভব হচ্ছে ২৫০ থেকে ২৮০ কোটি ঘনফুট। এরমধ্যে দৈনিক ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস আমদানি করা হয়। পেট্রোবাংলা ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ৮৩ কার্গো এলএনজি আমদানি করেছে, যার মধ্যে ২৬টি স্পট মার্কেট থেকে এবং বাকি ৫৭টি কাতার ও ওমানের দীর্ঘমেয়াদি চুক্তির আওতায়।

মিগার ঋণ গ্যারান্টি কার্যকর হলে এলএনজি আমদানির এই প্রক্রিয়া আরও সহজ হবে। একইসঙ্গে ভবিষ্যতে এই সুবিধা জ্বালানি তেল আমদানিতেও সম্প্রসারিত হতে পারে।

বিদ্যুৎ খাতে প্রভাব

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড প্রতিদিন ১০০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ পাচ্ছে, যা প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। ফলে তেল-ভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে, যা গ্যাস-ভিত্তিক বিদ্যুতের তুলনায় ৩ থেকে ৬ গুণ বেশি ব্যয়বহুল।

বিশ্বব্যাংকের মতে, পর্যাপ্ত গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করা গেলে বছরে প্রায় ২৫০ কোটি ডলার সাশ্রয় হবে। এমনকি আন্তর্জাতিক বাজারে গ্যাসের দাম বেড়ে গেলেও অন্তত ১৯০ কোটি ডলার সাশ্রয় সম্ভব।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

জ্বালানি বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বদরুল ইমাম মনে করেন, মিগার প্রস্তাবটি বাংলাদেশের জন্য একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ। তিনি বলেন, “যেহেতু জ্বালানি আমদানি করতেই হচ্ছে, কম সুদে অর্থায়নের সুযোগ সরকারকে অবশ্যই নিতে হবে। এটি দীর্ঘমেয়াদে অর্থনৈতিকভাবে উপকারী হবে।”

মিগার পূর্ববর্তী গ্যারান্টি কার্যক্রম

মিগা এর আগেও বাংলাদেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্পগুলোতে গ্যারান্টি দিয়েছে। উল্লেখযোগ্য প্রকল্পগুলোর মধ্যে রয়েছে ভোলার ২২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং ঘোড়াশাল পলাশ ইউরিয়া সার কারখানা।

বিশ্বব্যাংকের মিগার এই প্রস্তাব এলএনজি আমদানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করতে পারে। এটি না শুধু গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করবে, বরং দেশের বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ কমিয়ে অর্থনীতির ভারসাম্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button