অর্থনীতি

চালের বাড়তি দামের কারণে জুলাইয়ে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে: গভর্নর

Advertisement

বাংলাদেশের বাজারে চালের ক্রমবর্ধমান দামের প্রভাব সরাসরি পড়েছে দেশের সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির ওপর। জুলাই মাসে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে মূলত চালসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বৃদ্ধির কারণে। এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানিয়েছেন, বাজার স্থিতিশীল করতে হলে আমদানি নীতি সংস্কার অপরিহার্য।

মঙ্গলবার (১২ আগস্ট) দুপুরে বাংলাদেশ ব্যাংকের সদর দপ্তরে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে তিনি এই মন্তব্য করেন। এদিন কৃষি ও পল্লী ঋণ নীতিমালা ২০২৫-২৬ ঘোষণা করেন গভর্নর। সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং গণমাধ্যমের প্রতিনিধিরা।

চালের দামের ঊর্ধ্বগতি ও বাজার পরিস্থিতি

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এর তথ্য অনুযায়ী, জুলাই মাসে দেশের সাধারণ মূল্যস্ফীতি দাঁড়িয়েছে ৯.২ শতাংশে। এর মধ্যে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি ১০ শতাংশের বেশি। বিশেষজ্ঞদের মতে, চাল দেশের প্রধান খাদ্যশস্য হওয়ায় এর দামের ওঠানামা সরাসরি মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয়ে প্রভাব ফেলে।

২০২৫ সালের জুন ও জুলাই মাসে দেশীয় বাজারে চালের দাম প্রতি কেজিতে গড়ে ৩-৫ টাকা বেড়েছে। বিশেষ করে মাঝারি ও ভালো মানের চালের দাম সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। বাজারে সরবরাহের ঘাটতি, উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি এবং আমদানিতে জটিলতার কারণে এই মূল্যবৃদ্ধি হয়েছে বলে জানা গেছে।

আমদানি নীতি পরিবর্তনের প্রয়োজনীয়তা

গভর্নর আহসান এইচ মনসুর বলেন,

“নিত্যপণ্যের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে হলে আমাদের আমদানি প্রক্রিয়া সহজ ও কার্যকর করতে হবে। প্রয়োজন হলে শুল্ক কাঠামোতে সাময়িক সমন্বয় আনা যেতে পারে, যাতে বাজারে সরবরাহ বাড়ে এবং দাম স্থিতিশীল হয়।”

বর্তমানে চাল আমদানিতে শুল্কহার তুলনামূলক বেশি হওয়ায় বেসরকারি খাতের আমদানিকারকরা নিরুৎসাহিত হচ্ছেন। এছাড়া আন্তর্জাতিক বাজার থেকে চাল সংগ্রহের ক্ষেত্রে পরিবহন খরচ ও ডলার সংকটও সমস্যার সৃষ্টি করছে।

কৃষি খাতে ঋণ সম্প্রসারণ

সংবাদ সম্মেলনে গভর্নর জানান, চলতি অর্থবছরে কৃষি ও পল্লী উন্নয়নে ৩৯ হাজার কোটি টাকা ঋণ বিতরণের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। এটি গত অর্থবছরের লক্ষ্য (৩৮ হাজার কোটি টাকা) থেকে ২.৬ শতাংশ বেশি

বিদায়ী অর্থবছরে নির্ধারিত লক্ষ্যের বিপরীতে ৩৭ হাজার ৩২৬ কোটি টাকা বিতরণ করা হয়েছে। যদিও লক্ষ্যমাত্রা থেকে কিছুটা কম, বাংলাদেশ ব্যাংকের মতে, এটি একটি ইতিবাচক অর্জন।

গভর্নর আশা প্রকাশ করেন, কৃষি ঋণ প্রবাহ বাড়লে উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে, যা দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করবে এবং মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা রাখবে।

কেন চালের দাম বাড়ছে?

চালের দাম বৃদ্ধির কারণগুলো হলো:

  1. আবহাওয়াজনিত প্রভাব: বর্ষাকালে অতিরিক্ত বৃষ্টি ও বন্যায় আবাদি জমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
  2. উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি: সার, কীটনাশক, শ্রম ও জ্বালানির দাম বেড়েছে।
  3. সরবরাহ চেইনে সমস্যা: পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধি ও অব্যবস্থাপনা।
  4. আমদানি জটিলতা: উচ্চ শুল্কহার ও ডলার সংকটের কারণে যথাসময়ে আমদানি সম্ভব হয়নি।
  5. অভ্যন্তরীণ মজুদ ও মজুতদারি: কিছু ব্যবসায়ী অধিক লাভের আশায় পণ্য মজুদ রাখছেন।

বিশ্ববাজারের প্রভাব

আন্তর্জাতিক বাজারেও চালের দাম গত কয়েক মাসে বেড়েছে। থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম ও ভারতের রপ্তানি নীতিতে পরিবর্তন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে উৎপাদন হ্রাস—সবই বিশ্বব্যাপী চালের দাম বাড়িয়েছে। এর প্রভাব বাংলাদেশের বাজারেও পড়েছে।

ভারত, যেখান থেকে বাংলাদেশ অনেক চাল আমদানি করে, গত বছর কিছু প্রকার চালের রপ্তানি সীমিত করেছে, যা বাজারে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করেছে।

সরকার ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পদক্ষেপ

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সরকার ও বাংলাদেশ ব্যাংক কয়েকটি পদক্ষেপ নিয়েছে:

  • টিসিবি কার্যক্রম বাড়ানো: স্বল্প মূল্যে চাল, ডাল, তেল বিতরণ।
  • আমদানি শুল্ক হ্রাসের চিন্তাভাবনা: প্রয়োজনে সাময়িক শুল্ক কমানো হতে পারে।
  • কৃষি ঋণ বৃদ্ধি: উৎপাদন বাড়ানোর জন্য কৃষকদের সহজ শর্তে ঋণ প্রদান।
  • বাজার তদারকি জোরদার: অতিরিক্ত মজুদ ও কারসাজি রোধে মনিটরিং।

বিশেষজ্ঞদের মতামত

অর্থনীতিবিদ ড. মোহাম্মদ ফারুক বলেন,

“বাংলাদেশে খাদ্যপণ্যের মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হবে কেবল তখনই, যখন উৎপাদন ও সরবরাহ দুই ক্ষেত্রেই উন্নতি হবে। শুধু আমদানি নীতি পরিবর্তন যথেষ্ট নয়, বরং কৃষি অবকাঠামোতে বিনিয়োগ জরুরি।”

কৃষকের প্রত্যাশা ও চ্যালেঞ্জ

দেশের কৃষকরা আশা করছেন, নতুন ঋণ নীতিমালার আওতায় তারা পর্যাপ্ত অর্থায়ন পাবেন। তবে তারা মনে করেন, শুধু ঋণ নয়, প্রয়োজন বাজারে ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা।

কৃষক আবদুল করিম, নওগাঁ থেকে বলেন,

“আমরা ভালো উৎপাদন করলেও যদি ন্যায্যমূল্য না পাই, তাহলে লাভ হয় না। সরকারকে বাজার ব্যবস্থায় আরও মনোযোগ দিতে হবে।”

বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কৃষি খাত এখনও একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি। চালের দাম স্থিতিশীল রাখা শুধু খাদ্য নিরাপত্তার জন্য নয়, সামগ্রিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য অপরিহার্য। এজন্য সরকার, বাংলাদেশ ব্যাংক এবং বেসরকারি খাতের সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন।

যদি আমদানি নীতি সহজীকরণ, কৃষি উৎপাদন বৃদ্ধি, এবং বাজার তদারকি কার্যকরভাবে বাস্তবায়ন করা যায়, তবে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব হবে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন।

MAH – 12276 ,  Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Back to top button