
বাংলাদেশের জনপ্রিয় সবজির মধ্যে অন্যতম কাঁচা মরিচ। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে মরিচের চাষ হলেও বগুড়া জেলার মরিচ উৎপাদন চাহিদা ও সরবরাহের দিক থেকে বিশেষ স্থান অধিকার করে। তবে সাম্প্রতিককালে বগুড়া থেকে সরবরাহকৃত মরিচের বাজারমূল্যে অস্বাভাবিক ঊর্ধ্বগতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
গত কয়েক সপ্তাহে পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি কাঁচা মরিচের দাম যা ৮০ টাকা ছিল, তা বর্তমানে ১৫০ থেকে ১৮০ টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এমনকি মাঝে মধ্যে এক কেজি মরিচের দাম ২৫০ টাকাও স্পর্শ করেছিল। এই আশঙ্কাজনক ঊর্ধ্বগতি কৃষক, ব্যবসায়ী এবং ভোক্তাদের মধ্যে ব্যাপক উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে।
কাঁচা মরিচের দাম বৃদ্ধির প্রধান কারণ
স্থানীয় পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, চলতি বছরের আবহাওয়া পরিস্থিতি মরিচ চাষের জন্য বেশ অনুকূল নয়। বিশেষ করে অনাবৃষ্টি এবং অতিবৃষ্টির কারণে মরিচের খেতের ক্ষতি হয়েছে ব্যাপক মাত্রায়। ফলশ্রুতিতে মরিচের উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে এবং বাজারে সরবরাহ কমে যাওয়ায় মূল্য স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি বেড়েছে।
বগুড়ার রাজাবাজার এলাকার ব্যবসায়ী পরিমল প্রসাদ বলেন, “অতিবৃষ্টির কারণে মরিচের ক্ষেত নষ্ট হয়েছে, উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে পাইকারি বাজারে সরবরাহ কমেছে। এ অবস্থায় দাম বাড়া স্বাভাবিক।” তিনি আশা করেন, যেকোনো মুহূর্তে যদি আবহাওয়া স্বাভাবিক হয় এবং সরবরাহ বৃদ্ধি পায়, দাম ধীরে ধীরে কমতে শুরু করবে।
মহাস্থান হাটের পরিস্থিতি: দাম কি বর্ধিত হয়েছে অন্য সবজিতেও?
বগুড়ার মহাস্থান হাট দেশের অন্যতম বড় সবজি মোকাম। এখানে প্রতি দিন গড়ে ২০ ট্রাক সবজি আসা-যাওয়া করে থাকে, তবে গত কয়েকদিনে এই সংখ্যা কমে মাত্র ১০ ট্রাক হয়েছে। সরবরাহ কম হওয়ার ফলে শুধু মরিচই নয়, বরং অন্যান্য সবজির দামেও উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি দেখা গেছে।
গতকাল মহাস্থান হাটে পাইকারি বাজারে প্রতি কেজি করলা ৫০ টাকা, বরবটি ৪২ টাকা এবং দেশি শসা ৬৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা তুলনামূলকভাবে দুই সপ্তাহ আগে যথাক্রমে ৩০, ২৫ ও ৪০ টাকা ছিল। এর পাশাপাশি মুলা, কচুর লতি, লাউ, চালকুমড়া, বেগুন, পেঁপে, মিষ্টিকুমড়া সহ অধিকাংশ সবজির দামও বেড়েছে।
ভারত থেকে আমদানি হওয়া মরিচের বাজার
দেশীয় মরিচের দাম বাড়ায় আমদানি করা মরিচের চাহিদাও বেড়েছে। ভারত থেকে আমদানি করা কাঁচা মরিচ বর্তমানে প্রতি কেজি ১৬০ থেকে ১৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এতে অনেক ক্রেতা ভারতীয় মরিচের দিকে ঝুঁকছেন, যদিও দেশীয় মরিচের গুণগত মান অনেক বেশি।
বাজার ও ভোক্তাদের উপর প্রভাব
মরিচের দাম বৃদ্ধির ফলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনে প্রভাব পড়েছে। সবজি রাঁধার খরচ বেড়ে যাওয়ায় মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত পরিবারের বাজেট এখন অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়েছে। পাইকারি বাজারে দাম বাড়ার সাথে সাথে খুচরা বাজারেও দাম বেড়েছে, যা সবশেষে ভোক্তার গলায় গলায় পৌঁছে।
কৃষকদের দুঃখ-কষ্ট এবং সম্ভাব্য সমাধান
অতিবৃষ্টির কারণে মরিচ চাষের ক্ষতি হওয়ায় অনেক কৃষক বর্তমানে ক্ষতিগ্রস্ত। তাদের আয়ের প্রধান উৎস কমে যাওয়ায় সমস্যা আরও বাড়ছে। সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত কৃষকদের জন্য জরুরি সহায়তা ব্যবস্থা নেওয়া এবং মরিচের নতুন বীজ ও আধুনিক চাষাবাদের জন্য প্রশিক্ষণ প্রদান করা।
সরবরাহ বৃদ্ধি করতে মাঠ পর্যায়ে সেচ সুবিধা উন্নতকরণ, বৃষ্টিপাতের পূর্বাভাস ও প্রতিরোধ ব্যবস্থা গ্রহণের ওপর গুরুত্ব দিতে হবে। এছাড়া, ক্ষতির পরিমাণ কমাতে মজুদ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও বাজার মনিটরিং ব্যবস্থা চালু করা জরুরি।
সার্বিক পরিস্থিতি ও ভবিষ্যত পূর্বাভাস
বর্তমানে দেশের কাঁচা মরিচের বাজারে মূল্যবৃদ্ধির প্রধান কারণ আবহাওয়া ও সরবরাহ সংকট হলেও ভবিষ্যতে যদি বৃষ্টিপাত স্বাভাবিক থাকে, তাহলে ধীরে ধীরে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসার সম্ভাবনা রয়েছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, “মরিচের উৎপাদন যদি আগের মাত্রায় ফিরে আসে, বাজারে সরবরাহ বৃদ্ধি পায়, তাহলে আগামী মাসগুলোতে দাম কমতে পারে। তবে চাহিদার অনুপাতে সরবরাহ না হলে দাম বেড়ে যাওয়াই স্বাভাবিক।”
বাংলাদেশের কৃষিপ্রধান অর্থনীতিতে সবজি, বিশেষ করে মরিচের মত মসলাদার সবজির বাজার মূল্য বৃদ্ধি সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে প্রভাবিত করে। বগুড়ার মত মরিচ উৎপাদন কেন্দ্রে আজ যে দাম বৃদ্ধি দেখা যাচ্ছে, তা একটি সতর্কবার্তা কৃষি ব্যবস্থাপনা ও বাজার নিয়ন্ত্রণের ওপর। সরকার, কৃষক ও ব্যবসায়ীদের মিলিত উদ্যোগেই এই সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
একদিকে উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি বাজারে পর্যাপ্ত সরবরাহ নিশ্চিত করতে হবে, অন্যদিকে মূল্য নিয়ন্ত্রণে সঠিক নীতি গ্রহণ করে ভোক্তাদের সুবিধা দিতে হবে। তবেই দেশের সাধারণ মানুষ সুস্থভাবে জীবন যাপন করতে পারবে।