দেশের স্বর্ণপ্রেমী এবং বিনিয়োগকারীদের জন্য দুঃসংবাদ, একদিনের ব্যবধানে ফের বেড়েছে স্বর্ণের দাম। বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন (বাজুস) ২৪ জুলাই জানিয়েছে, ২২ ক্যারেটের স্বর্ণের দাম ভরিতে ১ হাজার ৫৭৪ টাকা বাড়িয়ে ১ লাখ ৭৩ হাজার ১৭৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছে। একই সঙ্গে ২১, ১৮ ও সনাতন পদ্ধতির সোনার দামও আপডেট করা হয়েছে।
দেশের বাজারে স্বর্ণের মূল্য বৃদ্ধির কারণ কী?
বাংলাদেশে স্বর্ণের দাম বাড়ার পেছনে বেশ কিছু কারণ কাজ করছে। বাজুসের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বৃদ্ধি এবং স্থানীয় চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্যের ওঠানামা মূলত এই মূল্যবৃদ্ধির পেছনের প্রধান কারণ।
বিশ্বব্যাপী রাজনৈতিক অস্থিরতা, মুদ্রাস্ফীতি, এবং মুদ্রার মুল্য পরিবর্তন স্বর্ণের দাম বাড়াতে প্রভাব ফেলছে। বিশেষ করে চলমান আন্তর্জাতিক সংকট, যেমন অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারের অনিশ্চয়তা, যুদ্ধবিধ্বস্ত অঞ্চল, এবং বড় অর্থনৈতিক শক্তিগুলোর নীতিগত পরিবর্তন, স্বর্ণকে ‘সেফ হেভেন’ হিসেবে রাখছে। এর প্রভাব সরাসরি দেশীয় বাজারে পড়ছে।
বাজুসের সর্বশেষ ঘোষণা ও দাম নির্ধারণের বিস্তারিত তথ্য
২৪ জুলাই থেকে প্রযোজ্য নতুন মূল্য অনুযায়ী:
- ২২ ক্যারেট সোনা (প্রতিভরি = ১১.৬৬৪ গ্রাম):
দাম নির্ধারণ করা হয়েছে ১ লাখ ৭৩ হাজার ১৭৫ টাকা।
যা একদিন আগে থেকে ১ হাজার ৫৭৪ টাকা বেশি। - ২১ ক্যারেট সোনা:
নতুন দাম ১ লাখ ৬৫ হাজার ৩০২ টাকা। - ১৮ ক্যারেট সোনা:
দাম পড়েছে ১ লাখ ৪১ হাজার ৬৮৩ টাকা। - সনাতন পদ্ধতির সোনা:
দাম রাখা হয়েছে ১ লাখ ১৭ হাজার ২২৩ টাকা।
স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি রুপার দাম অপরিবর্তিত রয়েছে। ২২ ক্যারেট রুপার দাম প্রতি ভরি ২ হাজার ৮১১ টাকা। অন্যান্য ক্যারেট অনুযায়ী রুপার দামও আগের অবস্থায় আছে।
কেন স্বর্ণের দাম বাড়ছে?
আন্তর্জাতিক বাজারের প্রভাব
স্বর্ণের আন্তর্জাতিক বাজারে দাম গত কয়েক সপ্তাহ ধরে উঠানামা করছে। বিভিন্ন দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যখন আর্থিক উদ্দামতা কমানোর লক্ষ্যে সুদের হার বাড়াচ্ছে, তখন স্বর্ণের দাম স্বাভাবিকভাবেই প্রভাবিত হচ্ছে। বিশেষ করে আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভের নীতি পরিবর্তন বা ইউরোপের অর্থনৈতিক সংকট সরাসরি দাম বাড়ানোর বা কমানোর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
স্থানীয় বাজারের চাহিদা-সরবরাহের ভারসাম্য
বাংলাদেশে চলতি বছরই স্বর্ণের প্রতি চাহিদা বেড়েছে। নতুন বিয়ে, উৎসব, এবং বিনিয়োগের প্রবণতা বৃদ্ধি পাওয়ায় বাজারে স্বর্ণের চাহিদা বেড়েছে। অপরদিকে, আমদানি শুল্ক ও রুপার মূল্য ওঠানামা স্বর্ণ আমদানিকে ব্যাহত করছে, যা সরবরাহ সংকট তৈরি করেছে।
স্বর্ণে বিনিয়োগ: নিরাপদ আশ্রয় ও ঝুঁকি
স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির খবর বিনিয়োগকারীদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরেই স্বর্ণকে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে ধরা হয়। অর্থনৈতিক অস্থিরতার সময় এটি ‘সেফ হেভেন’ হিসেবে কাজ করে। তবে, মূল্যবৃদ্ধি বা হ্রাসের ঝুঁকি থাকার কারণে বিনিয়োগের আগে বাজার ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করা দরকার।
স্বর্ণ বিনিয়োগে কর ও ভ্যাটের দিকটিও মাথায় রাখতে হবে। সরকার ৫ শতাংশ ভ্যাট আর বাজুস ৬ শতাংশ মজুরি যোগ করার পর মোট খরচ বেড়ে যায়। ফলে বিনিয়োগকারীরা সঠিক সময়ে ক্রয়-বিক্রয় করলে লাভবান হতে পারেন।
বাংলাদেশে স্বর্ণের আমদানি ও বাজারের অবস্থা
বাংলাদেশ স্বর্ণ আমদানির ওপর নির্ভরশীল দেশ। দেশে যথেষ্ট খনিজ স্বর্ণ নেই, তাই প্রায় সম্পূর্ণ আমদানির মাধ্যমে বাজার পূরণ হয়। ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, এবং দক্ষিণ আফ্রিকা প্রধান আমদানিকারক দেশ।
শুল্ক ও ট্যাক্স নীতির পরিবর্তন এবং বৈশ্বিক স্বর্ণের বাজারের ওঠানামা স্থানীয় বাজারে দাম বাড়াতে বা কমাতে প্রভাব ফেলে। সম্প্রতি বিশ্ব বাজারে সোনার দাম বৃদ্ধির প্রেক্ষিতে আমদানিতে খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম বাড়ানো হয়েছে।
ভবিষ্যৎ প্রবণতা: স্বর্ণের বাজার কী দিকে যাবে?
বিশ্লেষকরা বলছেন, বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতা অব্যাহত থাকলে স্বর্ণের দাম আরও বৃদ্ধি পেতে পারে। বিশেষ করে বিশ্ববাজারে মুদ্রাস্ফীতি ও রাজনৈতিক সংকট চলতে থাকলে বিনিয়োগকারীরা স্বর্ণের দিকে ঝুঁকবেন।
অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলো যদি সুদের হার বাড়িয়ে অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করতে সক্ষম হয়, তবে স্বর্ণের দাম কিছুটা স্থিতিশীল হতে পারে বা সাময়িক হ্রাসও পেতে পারে।
রুপার বাজার ও স্বর্ণের সম্পর্ক
রুপার দাম বাড়ানো হয়নি বলেও বাজুস জানিয়েছে। রুপার দাম স্থিতিশীল থাকা স্বর্ণের দাম বৃদ্ধির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়। কারণ রুপার দাম বাড়লে স্বর্ণের খরচ কমে, আর কমলে বাড়ে। বাংলাদেশে রুপার দাম দেশের অর্থনীতির আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ সূচক, যা জুয়েলারি ব্যবসায় বড় ভূমিকা পালন করে।
স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি অর্থনীতিতে প্রভাব
স্বর্ণের দাম বাড়লে দেশের বিনিয়োগ বাজারে অস্থিরতা দেখা দেয়। একদিকে, সাধারণ মানুষ ও ব্যবসায়ীরা স্বর্ণ কেনার ক্ষেত্রে একটু থামেন। অন্যদিকে, যারা আগেই বিনিয়োগ করেছেন তারা লাভবান হন।
উচ্চ মূল্যবৃদ্ধির কারণে গহনা কেনাবেচায় নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে, যা জুয়েলারি শিল্পে সাময়িক মন্দা সৃষ্টি করতে পারে। তবে দীর্ঘমেয়াদে স্বর্ণের চাহিদা থাকায় বাজার স্থিতিশীল থাকে।
বাজুসের ভূমিকা ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
বাংলাদেশ জুয়েলার্স অ্যাসোসিয়েশন দেশের স্বর্ণ ও রুপার বাজার নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। বাজার পর্যবেক্ষণ কমিটি নিয়মিত মূল্য নির্ধারণ ও আপডেটের মাধ্যমে বাজারে স্বচ্ছতা বজায় রাখে।
তারা সরকারি নীতিমালা ও আন্তর্জাতিক বাজারের পরিস্থিতি খতিয়ে দেখে নিয়মিত দাম আপডেট করে, যাতে ক্রেতা ও বিক্রেতা উভয়েরই স্বার্থ সংরক্ষণ হয়।
একদিনের ব্যবধানে ফের স্বর্ণের দাম বৃদ্ধি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও বিশ্ববাজারের প্রভাব স্পষ্ট করে। যারা স্বর্ণে বিনিয়োগ করতে চান, তাদের জন্য বাজারের ওঠানামা বুঝে ধৈর্য ধরে কাজ করাই লাভজনক। পাশাপাশি, সরকার ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণ ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করে স্বর্ণবাজারে স্থিতিশীলতা আনা।
আপনি যদি এই খবরটি পছন্দ করে থাকেন বা আরও বিস্তারিত জানতে চান, আমাদের সিগনালবিডি ডটকমে নিয়মিত ভিজিট করুন।



