
বিশ্ব অর্থনীতির অস্থিরতার মধ্যেও সোনার দাম বৃদ্ধির লক্ষণ স্পষ্ট হচ্ছে। চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বিশ্ববাজারে সোনার দাম প্রায় ২৬ শতাংশ বেড়েছে। আর বিশ্ববাজারের সোনার বাজার বিশ্লেষণকারী অন্যতম প্রতিষ্ঠানের — ওয়ার্ল্ড গোল্ড কাউন্সিল (ডব্লিউজিসি) — সাম্প্রতিক প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বছরের বাকি সময়েও সোনার দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।
এই প্রতিবেদনে ডব্লিউজিসি বলেছে, বিশ্ব অর্থনীতি ও রাজনৈতিক অস্থিরতা, ডলারের বিনিময় হার হ্রাস, কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর সোনা ক্রয়ের ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা, এবং বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ বৃদ্ধিই মূলত সোনার মূল্যবৃদ্ধির কারণ।
বিশ্ববাজারে সোনার দাম কেন বাড়ছে?
বিশ্বজুড়ে অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ভূরাজনৈতিক সংকট এবং মুদ্রার অবমূল্যায়নের মধ্যেই সোনা ক্রেতাদের কাছে সুরক্ষার প্রতীক হিসেবে বেশি আকর্ষণীয় হচ্ছে। চলতি বছরের প্রথমার্ধে সোনার দাম বৃদ্ধি পাওয়ার পেছনে প্রধান কারণগুলো হলো:
- ডলারের অবমূল্যায়ন: ডলার দামের পতন হলে অন্যান্য মুদ্রায় সোনা তুলনামূলক সস্তা হয়ে যায়। ফলে সোনার চাহিদা বাড়ে, যা দাম বৃদ্ধির অন্যতম কারণ।
- ভূরাজনৈতিক অস্থিরতা: ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনা, মধ্যপ্রাচ্যে ইরান-ইসরায়েল দ্বন্দ্বসহ বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন স্থানে সংঘর্ষ ও রাজনৈতিক অস্থিরতা সোনার দাম বাড়ানোর পেছনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।
- বিনিয়োগকারীদের আগ্রহ: শেয়ারবাজার ও অন্যান্য বিনিয়োগ ক্ষেত্রে ঝুঁকির কারণে নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে সোনার প্রতি আগ্রহ বেড়েছে।
- কেন্দ্রীয় ব্যাংকগুলোর ক্রয়: অনেক দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক সোনা কেনায় আগ্রহী হচ্ছে, বিশেষ করে ডলারের উপর নির্ভরতা কমানোর জন্য।
বিশ্বের বড় বড় অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, মন্দা বা অর্থনৈতিক স্থবিরতা বৃদ্ধি পেলে সোনার চাহিদা আরও বৃদ্ধি পাবে।
সোনার দাম কতটা বাড়তে পারে?
ডব্লিউজিসি’র পূর্বাভাস অনুযায়ী, ২০২৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধে সোনার দাম আরো ৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়তে পারে। তবে বৈশ্বিক অর্থনীতির পরিস্থিতি আরও অবনতি হলে এই বৃদ্ধির হার ১৫ শতাংশ পর্যন্ত পৌঁছতে পারে।
এই বছরের প্রথমার্ধে দাম বৃদ্ধির পরবর্তী সময়ে বাজার একটু স্থিতিশীল ছিল। তবে সাম্প্রতিক সময়ে সোনার বাজারে বড় ধরনের ওঠাপড়া না থাকলেও এর পেছনে একটি গঠনমূলক শক্তি কাজ করছে, যা ভবিষ্যতে দাম বৃদ্ধির জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভিত্তি হয়ে দাঁড়াবে।
বিশেষভাবে লক্ষ্য করা যায়, নতুন নতুন প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারী সোনায় আগ্রহী হচ্ছে, যারা ভবিষ্যতে দীর্ঘমেয়াদে সোনার চাহিদা ধরে রাখবে।
ডিডলারাইজেশন এবং সোনার বাজার
বিশ্বের অনেক দেশই ডলারের প্রভাব কমানোর চেষ্টা করছে, যা ‘ডিডলারাইজেশন’ নামে পরিচিত। ডলারের শক্তি কমে গেলে দেশগুলো সুরক্ষার জন্য সোনায় বেশি বিনিয়োগ করবে।
এই প্রবণতা বিশেষ করে বিকাশমান দেশগুলোতে বেশি দেখা যাচ্ছে, যেখানে বৈদেশিক মুদ্রার ওপর নির্ভরতা কমানোর জন্য সোনা কেনা হচ্ছে। এর ফলে সোনার দাম দীর্ঘমেয়াদে বাড়তে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
সোনার দাম কমার সম্ভাবনা কী?
ডব্লিউজিসি বলেছে, এমনও হতে পারে যে, বিশ্ব রাজনীতিতে বড় সমঝোতা বা বাণিজ্যিক প্রবৃদ্ধির হঠাৎ উন্নতি ঘটলে সোনার দাম কমতে পারে। বিশেষত ১৭ শতাংশ পর্যন্ত দাম কমার সম্ভাবনা রয়েছে।
তবে সামগ্রিকভাবে মূল্যস্ফীতি, মুদ্রাস্ফীতি, এবং রাজনৈতিক উত্তেজনা থাকলে দাম কমার সম্ভাবনা সীমিত থাকবে।0
সাম্প্রতিক সময়ের বাজার পরিস্থিতি
গত এক মাসে বিশ্ববাজারে সোনার দাম ৫৯ ডলার হ্রাস পেয়েছে। এতে কিছুটা উদ্বেগ থাকলেও, বিশ্লেষকরা মনে করছেন এটি স্বাভাবিক বাজারের ওঠাপড়া। বিশেষ করে মধ্যপ্রাচ্যে যুদ্ধবিরতি সোনার বাজারে চাপ কমিয়েছে।
তবে ট্রাম্প প্রশাসনের শুল্ক নীতি এবং বৈদেশিক বাণিজ্য সংক্রান্ত অনিশ্চয়তার কারণে সোনার বাজারে তেমন ইতিবাচক বা নেতিবাচক প্রভাব পড়েনি। শেয়ারবাজারও এই বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়নি, যার ফলে সোনার চাহিদা তুলনামূলক স্থিতিশীল রয়েছে।
সোনার বর্তমান দাম এবং বাজারের দৃষ্টিভঙ্গি
গোল্ড প্রাইস ডট অর্গের তথ্যমতে, ১৭ জুলাই ২০২৫-এ বিশ্ববাজারে সোনার দাম আউন্স প্রতি ৩,৩৪২ ডলার। রূপার দাম আউন্স প্রতি ৩৮ ডলার। বিশ্লেষকরা মনে করেন, সোনার দাম আউন্স প্রতি ৩,৩০০ ডলারের আশেপাশে স্থিতিশীল থাকলে বেচাকেনা বাড়বে। যদি দাম ৩,২৫০ ডলারের নিচে নামে, তবুও বাজারে ক্রেতা ক্রমশ বেশি আগ্রহী হবে।
বিশ্ব বাজারে ডলারের বিনিময় হার সাম্প্রতিককালে কমেছে। ডলার দুর্বল হলে অন্যান্য মুদ্রায় সোনা সস্তা হয়ে ওঠে, যা চাহিদা বাড়ায় এবং সোনার দাম বাড়ার কারণ হয়।
সোনার বিশেষ গুরুত্ব এবং নিরাপত্তা
বিশ্বব্যাপী সোনা সর্বাধিক স্থিতিশীল এবং নিরাপদ বিনিয়োগ হিসেবে বিবেচিত। ইতিহাস বলছে, বড় ধরনের অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক অস্থিরতার সময়ে সোনার দাম সাধারণত পতন হয় না, বরং বাড়ে।
বিগত ৫০ বছরে সোনায় বিনিয়োগ করা ব্যক্তিরা সাধারণত লাভবান হয়েছেন, যেখানে শেয়ারবাজার, মুদ্রার বিনিময় হার বা অন্যান্য বিনিয়োগ মাধ্যম অনেক সময় লোকসান দিয়েছে।
সুতরাং, বিনিয়োগকারীদের জন্য সোনা একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসেবে আজও জনপ্রিয়।
বাংলাদেশ ও সোনার বাজার
বাংলাদেশে সোনার চাহিদা বছরের পর বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। দেশের সাধারণ মানুষ সোনাকে প্রাচীনকাল থেকেই সঞ্চয়ের এক প্রধান মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
বর্তমানে আন্তর্জাতিক বাজারে সোনার দাম বাড়ার ফলে বাংলাদেশেও সোনার দাম ঊর্ধ্বমুখী। বিশেষ করে বিবাহ, ধর্মীয় উৎসব ও বিভিন্ন সামাজিক অনুষ্ঠানে সোনার ব্যবহার বেড়ে যাওয়ায় বাজারে চাহিদা বাড়ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকও নিয়মিত বাজার পর্যবেক্ষণ করে থাকে এবং সোনার আমদানি নিয়ন্ত্রণে রাখে। দেশের অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য সোনার দাম নিয়ন্ত্রণ একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
সোনায় বিনিয়োগের পথ ও সতর্কতা
বিশ্ব অর্থনীতির বর্তমান অস্থিরতা এবং ভবিষ্যতের অনিশ্চয়তার মধ্যে সোনায় বিনিয়োগ বিনিয়োগকারীদের কাছে বুদ্ধিমানের কাজ। তবে, বাজারের ওঠানামা ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করা জরুরি।
ডব্লিউজিসি’র পরিসংখ্যান ও বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট, ২০২৫ সালে সোনার দাম বৃদ্ধির সম্ভাবনা বেশি থাকলেও, কখনো কখনো বড় ধরনের সমঝোতা বা বৈশ্বিক উন্নতির কারণে দাম হ্রাসও পেতে পারে।
বিনিয়োগকারীদের উচিত বাজারের গতিবিধি বুঝে, দীর্ঘমেয়াদী দৃষ্টিকোণ থেকে সোনায় বিনিয়োগ করা।
সোনা শুধু একটি ধাতু নয়, এটি বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক নিরাপত্তার প্রতীক। তাই সোনায় বিনিয়োগ করাই এখন সবচেয়ে নিরাপদ ও লাভজনক পন্থা বলে মনে করা হচ্ছে।