এক সময়ের লাভজনক গাজী ওয়্যারস এখন লোকসানে

একসময় লাভে ভাসলেও, এখন ক্ষতির মুখে গাজী ওয়্যারস
বাংলাদেশের একমাত্র রাষ্ট্রায়ত্ত তামার তার প্রস্তুতকারী প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস এখন মারাত্মক লোকসানের মুখে। ২০২৩–২৪ অর্থবছরে প্রতিষ্ঠানটির লোকসান দাঁড়িয়েছে প্রায় ৫ কোটি ৬৩ লাখ টাকা, যেখানে চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত লোকসানের অঙ্ক পৌঁছেছে ৫ কোটি ৪১ লাখ টাকায়। চার বছরের ব্যবধানে এই লোকসান বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ।
একসময় লাভবান, আজ কেন এমন পরিণতি?
গাজী ওয়্যারস প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ১৯৬৫ সালে। জাপানের ফুরুকাওয়া ইলেকট্রিক কোম্পানির সহযোগিতায় এই প্রতিষ্ঠানটি চালু হয়। ১৯৭২ সালে জাতীয়করণের পর এটি বাংলাদেশ ইস্পাত ও প্রকৌশল করপোরেশনের (BSEC) আওতায় আসে। দীর্ঘদিন লাভে থাকা এই প্রতিষ্ঠানটির মূল ক্রেতা ছিল বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (BREB)। তারা প্রতিবছর গড়ে ৪০০ টন তামার তার কিনত গাজী ওয়্যারস থেকে।
তবে ২০২০–২১ অর্থবছরের পর থেকে বিআরইবি আর কোনো অর্ডার দেয়নি, মূলত দামের অজুহাত দেখিয়ে। এর ফলে প্রতিষ্ঠানটি সরাসরি বিপুল আর্থিক ক্ষতির মুখে পড়ে।
১১ গুণ লোকসানের পেছনে কারণ কী?
১. প্রধান ক্রেতার অর্ডার বন্ধ:
গাজী ওয়্যারসের আয়ের প্রধান উৎস ছিল বিআরইবি। তারা যখন অর্ডার বন্ধ করে দেয়, তখন প্রতিষ্ঠানটি কার্যত দিশাহারা হয়ে পড়ে।
২. বিকল্প বাজারে প্রবেশের অভাব:
বিআরইবি অর্ডার বন্ধ করার পরেও প্রতিষ্ঠানটি সময় মতো বিকল্প বাজার খোঁজেনি। এমনকি অন্য সরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছেও সে অর্থে সাপ্লাই শুরু হয়নি।
৩. উৎপাদন ক্ষমতার অপচয়:
প্রতিষ্ঠানটির বার্ষিক উৎপাদনক্ষমতা ১৫০০ টন হলেও, ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে মাত্র ২৬৭ টন। চলতি অর্থবছরে এপ্রিল পর্যন্ত উৎপাদন মাত্র ৮৭ টন।
৪. উৎপাদন খরচ বেশি:
প্রতি কেজি তামার তার উৎপাদনে খরচ হচ্ছে প্রায় ১৬০০ থেকে ১৮০০ টাকা, যেখানে বাজারের প্রতিযোগিতামূলক দাম কম।
৫. ব্যবস্থাপনার দুর্বলতা ও অনিয়ম:
২০১৮ সালে বিএসইসির এক তদন্তে উঠে আসে গাজী ওয়্যারসের আধুনিকীকরণ প্রকল্পে দুর্নীতি। প্রকল্পে ৪৫ কোটি টাকার যন্ত্রপাতি কেনা হলেও কোন দেশ থেকে আসা, সেই তথ্য স্পষ্ট নয়। এমনকি কেনার আগে মন্ত্রণালয়ের অনুমতিও নেওয়া হয়নি।
গাজী ওয়্যারস কী তৈরি করে?
গাজী ওয়্যারস বর্তমানে তিন ধরনের তামার তার তৈরি করে:
- সুপার এনামেল তামার তার (Gauge 12-46)
- এনিল্ড তামার তার (Gauge 10-46)
- হার্ড ড্রন বেয়ার তামার তার (Gauge 1-46)
এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি উৎপাদন ও বিক্রি হয় সুপার এনামেল তার। বর্তমানে প্রতিষ্ঠানটিতে কাজ করছেন ১২৮ জন কর্মকর্তা, কর্মচারী ও শ্রমিক।
ব্যবস্থাপনা কী বলছে?
গাজী ওয়্যারসের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল হালিম জানিয়েছেন, বিআরইবি দাম বেশি বলায় তারা অর্ডার বন্ধ রেখেছে। তবে গাজী ওয়্যারস ভালো মানের তার উৎপাদন করে বলে দাবি করেন তিনি। তাঁর মতে, লোকসান কাটিয়ে উঠতে বিকল্প বাজার তৈরির চেষ্টা চলছে।
তিনি আরও জানান, “জ্বালানি মন্ত্রণালয় সম্প্রতি সব সরকারি প্রতিষ্ঠানকে গাজী ওয়্যারস থেকে পণ্য কেনার নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়া পেট্রোবাংলা, বিপিসি ও কৃষি মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকেও আমাদের পণ্য নিতে বলেছি।”
বিআরইবি গত ২২ মে গাজী ওয়্যারস কারখানা পরিদর্শন করেছে। নতুন করে দর আলোচনা চলছে। যদি অর্ডার আবার শুরু হয়, তাহলে প্রতিষ্ঠানটি আবার লাভে ফিরতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।
বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণ
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসা গবেষণা ব্যুরোর পরিচালক অধ্যাপক মো. আলী আরশাদ চৌধুরী বলেন, “একটি প্রতিষ্ঠানের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে তার বাজার সম্প্রসারণ ও বহুমুখী ক্রেতার ওপর। গাজী ওয়্যারস দীর্ঘদিন ধরে একটি মাত্র ক্রেতার ওপর নির্ভরশীল ছিল। এটা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ কৌশল।”
তিনি বলেন, “সঠিক পরিকল্পনা ও পেশাদার ব্যবস্থাপনা না থাকলে, যেকোনো শিল্প প্রতিষ্ঠান ধ্বংস হয়ে যেতে পারে। গাজী ওয়্যারসের সেই পরিণতি এখন চোখের সামনে দৃশ্যমান।”
লোকসানের পরিসংখ্যান
অর্থবছর | মুনাফা/লোকসান (টাকা) |
---|---|
২০২০–২১ | ৪ কোটি ৭২ লাখ (মুনাফা) |
২০২১–২২ | ২ কোটি ১৩ লাখ (লোকসান) |
২০২২–২৩ | ৩ কোটি ৬০ লাখ (লোকসান) |
২০২৩–২৪ | ৫ কোটি ৬৩ লাখ (লোকসান) |
২০২৪–২৫ (এপ্রিল পর্যন্ত) | ৫ কোটি ৪১ লাখ (লোকসান) |
চার বছরে লোকসানের হার বেড়েছে প্রায় ১১ গুণ। এটি কেবল আর্থিক ক্ষতি নয়, বরং রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় হিসেবেও বিবেচিত হচ্ছে।
ঘুরে দাঁড়ানোর সম্ভাবনা কী?
সরকার যদি যথাযথ পরিকল্পনায় সহায়তা করে, তবে গাজী ওয়্যারস আবার লাভে ফিরতে পারে। কিছু গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হতে পারে:
- সরকারি সকল প্রতিষ্ঠানে গাজী ওয়্যারসের তার বাধ্যতামূলকভাবে ব্যবহারের নির্দেশ
- উৎপাদন খরচ কমাতে যন্ত্রপাতির আধুনিকীকরণ
- দক্ষ ব্যবস্থাপনা টিম গঠন
- রপ্তানি বাজারে প্রবেশের উদ্যোগ
বিশেষজ্ঞদের মতে, “সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় এবং বিএসইসি যদি স্বচ্ছ ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নেয়, তবে গাজী ওয়্যারস পুনরায় ঘুরে দাঁড়াতে পারবে। তবে তার জন্য প্রয়োজন রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও প্রশাসনিক গতি।”
একসময় লাভে থাকা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান গাজী ওয়্যারস আজ ধুঁকছে অব্যবস্থাপনা, পরিকল্পনার অভাব ও বাজার সংকোচনের কারণে। তবে সঠিক দিকনির্দেশনা ও সমন্বিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে এই ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠান আবারও দেশের জন্য একটি লাভজনক সম্পদে পরিণত হতে পারে।