যুক্তরাষ্ট্র-কানাডায় কুকুরের খাবারে গরুর লিঙ্গের চাহিদা বেড়েছে

বাংলাদেশে গরুর মাংস বিক্রির পর অবশিষ্টাংশ বা অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলোকে প্রায়ই অনির্বচনীয় ও নষ্ট হিসেবে মনে করা হয়। কিন্তু এর বিপরীতটা সত্যি। গরুর লিঙ্গ বা বুলস্টিক এখন বাংলাদেশের অন্যতম উচ্চমূল্যের রপ্তানি পণ্য হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। বিশ্ববাজারে বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডার কুকুরের খাবারের অন্যতম উপাদান হিসেবে ব্যাপক চাহিদা রয়েছে এই পণ্যের।
গরুর লিঙ্গ (বুলস্টিক) দিয়ে কীভাবে তৈরি হয় কুকুরের খাবার?
গরু ও মহিষের যৌনাঙ্গ থেকে তৈরি হয় বুলস্টিক নামের বিশেষ পণ্য, যা মূলত কুকুরের খাদ্যে ব্যবহার করা হয়। এই পণ্যের বাজার মূলত উন্নত দেশের, যেখানে কুকুর পালন একটি বিশাল শিল্প। যুক্তরাষ্ট্রে ৬০ শতাংশ এবং কানাডায় ৪০ শতাংশ এই পণ্য রপ্তানি হয়।
বাংলাদেশে বুলস্টিক রপ্তানির পরিসংখ্যান ও মূল্য
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সাম্প্রতিক তথ্য অনুযায়ী, গত অর্থবছরে শুধু মে মাসেই ১৪,৭৫২ কেজি বুলস্টিক রপ্তানি হয়েছে, যার বাজারমূল্য প্রায় ৩ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে মোট রপ্তানির পরিমাণ ছিল প্রায় ১ লাখ ২ হাজার কেজি, যার মূল্য প্রায় ২০ কোটি টাকা।
এই পণ্যের প্রতি কেজির মূল্য ১৮ থেকে ৩৫ মার্কিন ডলারের মধ্যে পরিবর্তিত হয়, যা বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ১৮০০ থেকে ৩৫০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে।
গরু জবাইয়ের পর বুলস্টিক সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণ
গরু ও মহিষ জবাইয়ের পর যৌনাঙ্গগুলি আলাদা করে সংগ্রহ করা হয়। প্রথমে এসব ভালোমতো ধুয়ে, চামড়া ও চর্বি অপসারণ করা হয়। এরপর মূত্রনালি আলাদা করে পরিষ্কার করে বুলস্টিককে শুকানোর জন্য প্রস্তুত করা হয়।
সাধারণত বুলস্টিক রোদে শুকানো হলেও এতে ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণের ঝুঁকি থাকে। তাই বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলো ওভেনে ৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপে ৬০ মিনিট ধরে শুকানোর পদ্ধতি ব্যবহার করে থাকে, যা পণ্যের গুণগত মান নিশ্চিত করে।
রপ্তানির জন্য বুলস্টিককে ৬ ও ১২ ইঞ্চির মাপে কেটে ভ্যাকুয়াম প্যাকিং করা হয়। এতে পণ্যটির দীর্ঘায়ু ও বাজারে গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়।
বুলস্টিক সংগ্রহের কাজ কে করে?
দেশে প্রতিবছর এক কোটির বেশি গরু ও মহিষ জবাই হয়। এর মধ্যে থেকে বুলস্টিক সংগ্রহ করেন মধ্যস্বত্বভোগী ও ব্যবসায়ীরা।
সাভারের হেমায়েতপুরের হাফিজুর রহমান প্রতি মাসে ১৫ থেকে ১৭ হাজার বুলস্টিক সংগ্রহ করেন বরিশাল, কুষ্টিয়া, যশোরসহ আশপাশের ১৫টির বেশি জেলা থেকে। তিনি জানান, এই ব্যবসা থেকে প্রতি মাসে ১ থেকে ১ লাখ ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করেন।
সিরাজগঞ্জের একরামুল হক সাত বছর ধরে বুলস্টিক ব্যবসা করছেন। তিনি প্রতি মাসে প্রায় ৪০ হাজার বুলস্টিক সংগ্রহ করেন এবং মাসিক আয় ৬০ থেকে ৭০ হাজার টাকা। সারাদেশে অন্তত ১৮ থেকে ২০ জন ব্যবসায়ী এই পেশায় যুক্ত।
রপ্তানির বাজার ও সম্ভাবনা
বর্তমানে বুলস্টিক রপ্তানির প্রধান বাজার যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডা হলেও ইউরোপীয় বাজারেও প্রবেশের সম্ভাবনা রয়েছে। ইউরোপে প্রবেশ করতে গেলে গরু জবাইয়ের আগে বিএসই (বিভিন্ন স্পঞ্জিফর্ম এনসেফ্যালোপ্যাথি বা ম্যাডকাউ ডিজিজ) সার্টিফিকেটের প্রয়োজন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করলে আগামী কয়েক বছরে বুলস্টিক রপ্তানি দ্বিগুণ হবে।
বুলস্টিক রপ্তানিতে বাধা ও চ্যালেঞ্জ
বাংলাদেশের বুলস্টিক রপ্তানিতে বর্তমানে বেশ কিছু প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- প্রণোদনার অভাব: আগে ১০-১৫ শতাংশ প্রণোদনা থাকলেও এখন কমে ৬ শতাংশে নেমেছে, যার ফলে ব্যবসায়ীরা কম আগ্রহী হচ্ছেন।
- শুল্ক আরোপ: যুক্তরাষ্ট্রে নতুন শুল্ক আরোপ পণ্যের রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
- কাঁচামালের অভাব: কাঁচামাল সংগ্রহে অসুবিধার কারণে অনেক ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
- জীবাণুনাশক প্রক্রিয়া: যুক্তরাষ্ট্রে গামা রেডিয়েশন পদ্ধতিতে পণ্য জীবাণুমুক্ত করতে হয়, যা দেশে করা হলেও সময়সাপেক্ষ।
- বিনিয়োগ ও ব্যাংক ঋণের সমস্যা: অপ্রচলিত পণ্য হওয়ায় ব্যাংক ঋণ পাওয়ায় সমস্যা রয়েছে।
উন্নয়নের দিকনির্দেশনা ও করণীয়
- বুলস্টিক সংগ্রহ ও প্রক্রিয়াজাতকরণের জন্য আধুনিক কারখানা স্থাপন এবং প্রশিক্ষিত কর্মী প্রয়োজন।
- সরকারিভাবে রপ্তানিতে প্রণোদনা বাড়ানো উচিত, যাতে নতুন উদ্যোক্তারা উৎসাহিত হন।
- বিএসই ও আইএসও সার্টিফিকেটসহ মানসম্মত প্রক্রিয়া নিশ্চিত করার জন্য প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে হবে।
- দ্রুত গামা রেডিয়েশন সুবিধার প্রসার ঘটাতে হবে, যাতে সময় কম লাগে ও পণ্য দ্রুত রপ্তানি সম্ভব হয়।
- ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশের জন্য আন্তর্জাতিক মান পূরণে কাজ করতে হবে।
প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের উৎপাদন শাখার পরিচালক এ বি এম খালেদুজ্জামান বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রের অর্থায়নে গুড ল্যাবরেটরি প্র্যাকটিস প্রোগ্রাম চালু ছিল, তবে অর্থায়ন বন্ধ হওয়ায় প্রকল্প বিলম্বিত হয়েছে। সরকার ও বেসরকারি খাত একযোগে কাজ করলে এই ব্যবসার ব্যাপক উন্নয়ন হবে।”
বাংলাদেশে গরুর মাংসের পাশাপাশি গরুর অঙ্গপ্রত্যঙ্গ বিশেষ করে বুলস্টিক এক নতুন অর্থনৈতিক সুযোগ হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। উন্নত মান ও আধুনিক প্রক্রিয়াজাতকরণ ব্যবস্থা গড়ে তুলে বিশ্ববাজারে এর চাহিদা বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয় বাড়ানো সম্ভব। তবে ব্যবসার অগ্রগতির জন্য সরকারি সহযোগিতা, প্রণোদনা বৃদ্ধি ও মান নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য।