বিদায়ী অর্থবছরে রফতানি আয় বেড়েছে ৮ শতাংশ

ঈদের ছুটি ও এনবিআর ধর্মঘটের বাধা সত্ত্বেও গত অর্থবছরে দেশের রফতানি খাতে এসেছে চাঙ্গাভাব। তৈরি পোশাক খাতেই এসেছে সর্বোচ্চ আয়। বৈদেশিক রেমিট্যান্স এবং রিজার্ভ বৃদ্ধির সুখবরও রফতানি বৃদ্ধিকে আরো ইতিবাচক করেছে।
বিদায়ী অর্থবছরে রফতানিতে প্রবৃদ্ধি
২০২৪-২৫ অর্থবছর শেষে বাংলাদেশের রফতানি আয়ে এসেছে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি। সদ্য শেষ হওয়া অর্থবছরে পণ্য রফতানি থেকে আয় হয়েছে ৪৮.২৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় ৮.৫৮ শতাংশ বেশি। আগের অর্থবছরে রফতানি আয় ছিল ৪৪.৪৬ বিলিয়ন ডলার।
রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) প্রকাশিত সর্বশেষ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রায় প্রতিটি মাসেই রফতানি বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে জুন মাসে ঈদুল আজহার দীর্ঘ ছুটি এবং এনবিআর কর্মীদের ধর্মঘটের কারণে কিছুটা মন্দাভাব দেখা যায়।
তৈরি পোশাক খাতেই সর্বোচ্চ অবদান
একক পণ্য হিসেবে তৈরি পোশাক খাত থেকেই এসেছে সর্বোচ্চ রফতানি আয়। বিগত অর্থবছরে পোশাক খাত থেকে রফতানি আয় হয়েছে ৩৩.৩৫ বিলিয়ন ডলার, যা আগের অর্থবছরের তুলনায় প্রায় ২২০ কোটি ডলার বেশি।
এই খাতটি দেশের মোট রফতানি আয়ের প্রায় ৭০ শতাংশ অবদান রাখে। এ ছাড়াও চামড়া, হিমায়িত মাছ, হস্তশিল্প, কৃষিপণ্যসহ অন্যান্য খাত থেকেও উল্লেখযোগ্য আয় এসেছে।
জুনে রফতানিতে ধাক্কা
২০২৫ সালের জুন মাসে রফতানি কিছুটা কমে ৩.৩৪ বিলিয়ন ডলারে দাঁড়ায়, যা আগের বছরের জুন মাসের তুলনায় প্রায় ৭.৫ শতাংশ কম।
এর পেছনে বড় কারণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে ঈদুল আজহার কারণে প্রায় ১০ দিনের ছুটি এবং মাসের শেষে এনবিআর কর্মকর্তাদের পূর্ণাঙ্গ কর্মবিরতি। এ দুই কারণেই রফতানির স্বাভাবিক গতি ব্যাহত হয়।
পূর্বের তুলনায় উন্নতি
২০২৩-২৪ অর্থবছরে রফতানি আয়ের পরিমাণ ছিল ৪৪.৪৭ বিলিয়ন ডলার। এর আগের ২০২১-২২ অর্থবছরে রফতানিতে কিছু অনিয়মের অভিযোগ উঠেছিল, বিশেষ করে তথ্য গোপন ও অতিরঞ্জনের বিষয়ে। তবে এবার পরিসংখ্যান অপেক্ষাকৃত স্বচ্ছ এবং বিশ্বাসযোগ্য বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।
রেমিট্যান্সে রেকর্ড অর্জন
বিদায়ী অর্থবছরে শুধু রফতানিই নয়, রেমিট্যান্স খাতেও এসেছে দুর্দান্ত সাফল্য। চলতি অর্থবছরে রেমিট্যান্স এসেছে ৩০.৩৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২৭ শতাংশ বেশি।
শুধু জুন মাসেই এসেছে ২.৮২ বিলিয়ন ডলার। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারের হুন্ডি দমন, প্রণোদনা ও বৈধ পথে টাকা পাঠানোর সুবিধা বৃদ্ধির ফলেই এই প্রবৃদ্ধি অর্জন সম্ভব হয়েছে।
বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে স্বস্তি
রফতানি ও রেমিট্যান্স বৃদ্ধির প্রভাবে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভেও এসেছে স্বস্তি। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে, বর্তমান রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ৩১.৭১ বিলিয়ন ডলারে, যদিও আইএমএফের বিপিএম৬ পদ্ধতিতে এটি ২৬.৬৮ বিলিয়ন ডলার হিসেবে গণ্য হয়।
এই উন্নয়ন আন্তর্জাতিক ব্যাংকগুলোর আস্থা ফিরিয়ে এনেছে। ফলে ডলার সংকট অনেকটাই কাটিয়ে উঠেছে দেশ। ব্যাংকগুলো বর্তমানে ডলার কিনছে ১২৩ টাকায়, যা আমদানির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
দেশীয় অর্থনীতিতে ইতিবাচক বার্তা
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক বার্তা বহন করে। বৈদেশিক আয় বৃদ্ধি পাওয়ায় লেনদেন ভারসাম্যেও ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে।
২০২৩-২৪ অর্থবছরের জুলাই-এপ্রিল সময়ে যেখানে চলতি হিসাবে ঘাটতি ছিল ৬.০২ বিলিয়ন ডলার, তা কমে ২০২৪-২৫ সালের একই সময়ে দাঁড়িয়েছে মাত্র ১.৩৯ বিলিয়ন ডলারে। পুরো লেনদেন ভারসাম্যের ঘাটতি ৫.৫৯ বিলিয়ন থেকে কমে এসেছে ৬৫ কোটি ডলারে।
বিশেষজ্ঞদের মতামত
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান ও অর্থনীতিবিদদের মতে, বৈদেশিক খাতে এই সাফল্য সামগ্রিক অর্থনীতিকে গতি দিতে সহায়ক হবে। তবে এই ধারা অব্যাহত রাখতে হলে স্থিতিশীল নীতি, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ও বৈশ্বিক বাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকার সক্ষমতা বাড়ানো জরুরি।
“বর্তমান রফতানি পরিস্থিতি স্থিতিশীলতা ও বৈদেশিক আয়ের ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করতে একটি বড় পদক্ষেপ,”—অর্থনীতি বিশ্লেষক ড. মাহফুজ রহমান।
শেষ কথা
রফতানি আয় ও রেমিট্যান্সের এই উল্লম্ফনে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরেছে। ডলার সংকটের মতো দীর্ঘদিনের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে এই প্রবৃদ্ধি কার্যকর ভূমিকা রাখছে।
তবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতিযোগিতা ও বৈশ্বিক অর্থনীতির অস্থিরতার মুখে এই ইতিবাচক ধারা কতটা স্থায়ী হবে — সেটিই এখন সবচেয়ে বড় প্রশ্ন।
এম আর এম – ০১৫৮, Signalbd.com