অফশোর ব্যাংকিংয়ে টাকায় ঋণ পাওয়ার নতুন নিয়ম

ঢাকা, ৩ জুলাই ২০২৫ — বাংলাদেশ ব্যাংক সম্প্রতি একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রজ্ঞাপন জারি করেছে, যার মাধ্যমে দেশে ব্যবসা ও বিনিয়োগের ক্ষেত্র আরও সুবিধাজনক হয়ে উঠবে। নতুন নির্দেশনা অনুযায়ী, ব্যাংকগুলো এখন থেকে অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে (ওবিইউ) রাখা বৈদেশিক মুদ্রার তহবিলকে জামানত হিসেবে ব্যবহার করে দেশের কোম্পানি ও ব্যক্তিরা সহজেই টাকায় ঋণ নিতে পারবেন। এ ছাড়াও, প্রবাসী বাংলাদেশিরা ওবিইউতে জমাকৃত বৈদেশিক মুদ্রাকে জামানত হিসেবে রেখে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণ করতে পারবেন।
অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে জমা বৈদেশিক মুদ্রা জামানত হিসেবে ঋণ সুবিধা
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই নতুন প্রজ্ঞাপনে বলা হয়েছে, অনিবাসী হিসাবধারীদের ওবিইউতে থাকা বৈদেশিক মুদ্রাকে ডমেস্টিক ব্যাংকিং ইউনিটের মাধ্যমে টাকায় ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে জামানত হিসেবে ব্যবহার করার অনুমতি দেয়া হবে। অর্থাৎ, যারা বিদেশে আছেন বা বিদেশি কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত রেখেছেন, তারা এখন সেই আমানতকে নিরাপদ জামানত হিসেবে ব্যবহার করে দেশে টাকায় ঋণ নিতে পারবেন।
এতে প্রবাসী বাংলাদেশি, বিদেশি নাগরিক, বিদেশি ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান এবং বিদেশে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলোর জন্য বড় সুযোগ তৈরি হচ্ছে। এই নতুন নিয়ম বিদেশি বিনিয়োগ আকৃষ্টকরণে সহায়ক হবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন।
কারা সুবিধা পাবেন?
- প্রবাসী বাংলাদেশিরা: যারা বিদেশে থাকেন এবং ওবিইউতে বৈদেশিক মুদ্রা জমা রেখেছেন, তারা এই মুদ্রাকে জামানত হিসেবে ব্যবহার করে সহজে টাকায় ঋণ নিতে পারবেন।
- বিদেশি শেয়ারহোল্ডার ও বিনিয়োগকারী: যারা বাংলাদেশে বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি পরিচালনা করেন, তাদের জন্য স্থানীয়ভাবে জামানত সংগ্রহ কঠিন হলেও এখন বৈদেশিক মুদ্রা জামানত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে।
- বিদেশে নিবন্ধিত কোম্পানি: বিদেশে নিবন্ধিত কোম্পানিগুলিও বাংলাদেশে জমাকৃত বৈদেশিক মুদ্রার ওপর ভিত্তি করে ঋণ গ্রহণে সক্ষম হবেন।
ঋণের শর্তাবলী ও জামানতের ব্যবহারের সীমাবদ্ধতা
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, এই জামানত হিসেবে রাখা বৈদেশিক মুদ্রার বিপরীতে শুধুমাত্র স্বল্পমেয়াদি চলতি মূলধনি ঋণ প্রদান করা যাবে। অর্থাৎ, ব্যবসার দৈনন্দিন কার্যক্রম চালাতে প্রয়োজনীয় ঋণগুলোই এই নিয়মের আওতায় আসবে।
তবে জামানতের জন্য কোনো অতিরিক্ত মাশুল দিতে হবে না। আর ব্যাংকগুলোকে বাধ্য করা হয়েছে ঋণগ্রহীতা ও হিসাবধারীর মধ্যে যৌক্তিক সম্পর্ক নিশ্চিত করার জন্য। উদাহরণস্বরূপ, প্রবাসী বাংলাদেশি ও তাঁদের স্থানীয় সুবিধাভোগী, বিদেশি শেয়ারহোল্ডার, সংশ্লিষ্ট বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি ইত্যাদি।
বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় ব্যাংক প্রয়োজনবোধে জামানতের কিছু অংশ মার্জিন হিসেবে রাখতে পারবে। আর ঋণ পরিশোধ না হলে নির্ধারিত আনুষ্ঠানিকতা মেনে জামানত হিসেবে রাখা বৈদেশিক মুদ্রা নগদায়ন করে ঋণ সমন্বয় করা যাবে।
অন্যান্য বৈদেশিক মুদ্রা অ্যাকাউন্টেও ঋণের সুযোগ
এছাড়াও, প্রজ্ঞাপনে আরও বলা হয়েছে, ওবিইউ ছাড়াও প্রাইভেট ফরেন কারেন্সি অ্যাকাউন্ট এবং নন-রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট অ্যাকাউন্টে থাকা ব্যালান্সও জামানত হিসেবে ব্যবহার করে টাকায় ঋণ নেওয়া যাবে। তবে, ইন্টারন্যাশনাল ব্যাংকিং অ্যাকাউন্টে থাকা অর্থ জামানত হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না।
এই সিদ্ধান্তের ইতিবাচক প্রভাব
বাংলাদেশে পরিচালিত বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানি এবং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিবর্গ এই নতুন নিয়মকে অত্যন্ত স্বাগত জানিয়েছেন। তাদের মতে, স্থানীয়ভাবে জামানত সংগ্রহ করা অনেক সময় জটিল ও দীর্ঘপ্রক্রিয়াসম্পন্ন। এখন বিদেশি শেয়ারহোল্ডার বা বিনিয়োগকারী কোম্পানি বৈদেশিক মুদ্রায় জামানত রেখে সহজেই টাকায় ঋণ পাবে, যা ব্যবসার প্রসার ও বিনিয়োগ বৃদ্ধিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই সিদ্ধান্ত বৈদেশিক বিনিয়োগ উৎসাহিত করবে এবং দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও রপ্তানিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ব্যাখ্যা ও লক্ষ্য
বাংলাদেশ ব্যাংক জানায়, এই প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রার সঠিক ব্যবহারের পাশাপাশি আর্থিক বাজারের স্থিতিশীলতা বজায় রাখা হবে। এতে বৈদেশিক মুদ্রার আয়ের উৎসও সঠিকভাবে শনাক্ত করা সম্ভব হবে এবং ঋণ প্রদানের ক্ষেত্রে ঝুঁকি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।
এছাড়াও, এই উদ্যোগ বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতকে আরও আধুনিক ও আন্তর্জাতিক মানের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা যেন সহজে ও দ্রুত ব্যাংকিং সুবিধা পায়, সে জন্য এই প্রজ্ঞাপন গ্রহণ করা হয়েছে।
সামগ্রিক প্রভাব ও ভবিষ্যৎ প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক বছর ধরে দ্রুত বর্ধনশীল। এ সময় বিদেশি বিনিয়োগ ও রেমিট্যান্সের গুরুত্ব বেড়েছে। প্রবাসী বাংলাদেশিরা দেশে পাঠানো বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করেছে। এখন এই নতুন প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে তাদের জমাকৃত বৈদেশিক মুদ্রাকে জামানত হিসেবে ব্যবহার করে ঋণ নেওয়া যাবে, যা তাদের ব্যবসা সম্প্রসারণে ও নতুন উদ্যোগে সাহায্য করবে।
এছাড়া, বিদেশি মালিকানাধীন কোম্পানিগুলোর জন্যও এটি বড় সহায়তা হিসেবে কাজ করবে। দেশের ব্যাংকিং ব্যবস্থায় নতুন এই সুবিধা বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আস্থা বৃদ্ধি করবে এবং আন্তর্জাতিক ব্যবসার জন্য বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উন্নত করবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের এই যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত দেশের ব্যাংকিং খাতকে আরও উদ্ভাবনী ও কার্যকর করে তুলবে। অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটের বৈদেশিক মুদ্রাকে জামানত হিসেবে ব্যবহার করে টাকায় ঋণ পাওয়ার সুযোগ দেশীয় ও বিদেশি ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগকারীদের জন্য নতুন দিগন্ত খুলে দেবে। এতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও বৈদেশিক বিনিয়োগ প্রবাহ আরও ত্বরান্বিত হবে।