অর্থনীতি

রূপালী ব্যাংকে সরকারের মালিকানা বাড়ছে, কমছে সাধারণের শেয়ার

দেশের অন্যতম রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক রূপালী ব্যাংকে সরকারি মালিকানা ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেতে যাচ্ছে। সরকারের কাছ থেকে দেওয়া প্রায় ৭০০ কোটি টাকার পুনর্বরণ সহায়তা (রেক্যাপিটালাইজেশন ফান্ড) অবশেষে শেয়ারে রূপান্তরিত হচ্ছে। এর ফলে ব্যাংকের মূলধন প্রায় দেড়গুণ বৃদ্ধি পেয়ে ৯০০ কোটি টাকা ছুঁয়ে যাবে। তবে একই সঙ্গে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার মালিকানার অংশ কমে যাওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়েছে।

রূপালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ সোমবার শেয়ারধারীদেরকে এই সিদ্ধান্ত জানায়। কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন সময়ে সরকারের দেওয়া অর্থকে শেয়ারে রূপান্তর করার প্রক্রিয়া চলছিল। এবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনুমোদন নিয়ে ২৭ আগস্ট একটি বিশেষ সাধারণ সভা (ইজিএম) ডাকা হয়েছে, যেখানে শেয়ারধারীদের অনুমোদনের ভিত্তিতে সরকারি ঋণ শেয়ারে রূপান্তরের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হবে।

শেয়ার ইস্যু ও মূলধনের বিশদ তথ্য

রূপালী ব্যাংক নতুন করে ৪৫ কোটি ৩৩ লাখ ৩০ হাজার ২৫৩টি শেয়ার ইস্যু করবে। এই শেয়ারের মূল্য ধরা হয়েছে ১৫ টাকা, যার মধ্যে ১০ টাকা অভিহিত মূল্য (ফেস ভ্যালু) এবং ৫ টাকা প্রিমিয়াম। সরকারের কাছে থাকা প্রায় ৬৮০ কোটি টাকার ঋণ এই শেয়ারে রূপান্তরিত হবে।

নতুন শেয়ার ইস্যুর ফলে ব্যাংকের মূলধন বাড়বে প্রায় ৪৫৩ কোটি টাকা, এবং প্রায় ২২৭ কোটি টাকা শেয়ার প্রিমিয়াম হিসাবে যুক্ত হবে। এতে ব্যাংকের মোট মূলধন দাঁড়াবে প্রায় ৯৪১ কোটি টাকা, যা বর্তমানে ৪৮৮ কোটি টাকার দ্বিগুণেরও বেশি।

ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের মোট শেয়ারের সংখ্যা প্রায় ৪৯ কোটি। নতুন শেয়ার ইস্যুর পর তা বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৯৪ কোটি।

সরকারের মালিকানা বাড়ার প্রভাব

বর্তমানে রূপালী ব্যাংকের শেয়ারের ৯০.১৯ শতাংশ সরকারের হাতে রয়েছে, বাকিটা সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে বিভক্ত। নতুন শেয়ার ইস্যু করার পর এই অংশ আরও বাড়িয়ে প্রায় ৯৫ শতাংশে নিয়ে যাওয়া হবে। এর ফলে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মালিকানার অংশ কমে ৫ শতাংশে নেমে আসবে।

বর্তমানে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের মধ্যে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগকারীদের হাতে ৩.৩৯ শতাংশ এবং ব্যক্তিগত বিনিয়োগকারীদের হাতে প্রায় ৬.৫ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। শেয়ার ইস্যু হয়ে গেলে তাদের মালিকানা কমে যাবে উল্লেখযোগ্যভাবে।

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থার বিধান ও বিতর্ক

বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি) ২০২১ সালে একটি বিধান দিয়েছিল, যেখানে বলা হয়েছিল, যেসব কোম্পানির পরিশোধিত মূলধন ১৫০ কোটি টাকার বেশি, সেগুলোর শেয়ারের অন্তত ১০ শতাংশ সাধারণ বিনিয়োগকারীদের হাতে থাকতে হবে। এই বিধান অনুসারে, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের শেয়ার অংশ কমানো যাবে না।

তবে রূপালী ব্যাংকের শেয়ার ইস্যুর কারণে এই বিধানের ব্যতিক্রম ঘটছে, যা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা। বিএসইসির মুখপাত্র মো. আবুল কালাম প্রথম আলোর কাছে জানিয়েছেন, “ব্যাংকটি পুনরায় আবেদন করলে সংশ্লিষ্ট বিধিবিধান অনুযায়ী অনুমোদন দেওয়া হবে।”

কেন বাড়ানো হচ্ছে সরকারি মালিকানা?

রূপালী ব্যাংক সরকারের কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন সময়ে নগদ অর্থ সহায়তা পেয়েছে। আর্থিক দিক থেকে ব্যাংকের নিজস্ব অর্থ দিয়ে ঋণ পরিশোধ সম্ভব নয় বলে এসব অর্থ শেয়ারে রূপান্তর করা হচ্ছে। অর্থাৎ, সরকারের দেওয়া ঋণ ফেরত দিতে না পারায় সেটিকে শেয়ার মূলধনে রূপান্তর করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

এটি ব্যাংকের আর্থিক শক্তি বাড়াতে সহায়ক হলেও, সাধারণ বিনিয়োগকারীদের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ সংকেতও বটে — ব্যাংকের শেয়ারবাজারে ট্রেডেবল শেয়ারের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণে লিকুইডিটি বা শেয়ারের বাজার মূল্য প্রভাবিত হতে পারে।

সরকারী কোম্পানি শেয়ারবাজারে নিয়ে আসার প্রচেষ্টা ও প্রভাব

বর্তমানে সরকার বিভিন্ন রাষ্ট্রায়ত্ত প্রতিষ্ঠান ও কোম্পানিকে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত করার উদ্যোগ নিচ্ছে। নতুন কোম্পানি বাজারে আনার পাশাপাশি বিদ্যমান কোম্পানিগুলোর শেয়ার বাজারে আরও ছাড়ার পরিকল্পনা চলছে।

এই প্রেক্ষাপটে রূপালী ব্যাংকের মালিকানা বৃদ্ধির ঘটনা সরকারের শেয়ার বাজারের কৌশলের অংশ হিসেবেও দেখা হচ্ছে। তবে শেয়ারবাজারে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশ কমানোর বিষয়টি ভবিষ্যতে বাজারের স্বচ্ছতা ও স্থিতিশীলতার জন্য কি প্রভাব ফেলবে, তা সময় বলবে।

রূপালী ব্যাংকের গুরুত্ব ও ভবিষ্যত পরিকল্পনা

রূপালী ব্যাংক দেশের অন্যতম প্রধান রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে আসছে। সরকারের মালিকানার বৃদ্ধির মাধ্যমে ব্যাংকের আর্থিক সক্ষমতা বাড়ার আশা করা হচ্ছে। তবে একই সঙ্গে ব্যাংকের শেয়ার বাজারে স্বচ্ছতা এবং সাধারণ বিনিয়োগকারীদের স্বার্থ রক্ষা করাও গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।

বর্তমান পরিস্থিতিতে ব্যাংকের শেয়ার ইস্যু ও মালিকানা কাঠামোর পরিবর্তনের ফলে ব্যাংকের পরিচালনা ও শেয়ার বাজারে তার অবস্থান নতুন চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ উভয়ই তৈরি করবে।

সরকারের মালিকানা বৃদ্ধির ফলে রূপালী ব্যাংকের মূলধন শক্তিশালী হবে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক। তবে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের অংশ কমে যাওয়া এবং শেয়ারবাজারে লেনদেনযোগ্য শেয়ারের সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি বাজারের জন্য কিছুটা উদ্বেগের কারণ হতে পারে।

বিএসইসির বিধান ও বাজারের স্বার্থ রক্ষার মধ্যে সঠিক সমন্বয় তৈরি করা এখন প্রধান চ্যালেঞ্জ। রূপালী ব্যাংকের ভবিষ্যত সফলতা এই নীতিগত সমঝোতার উপর নির্ভর করবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button