অর্থনীতি

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ৩ হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়ে গেল

প্রবাসী আয় ও বৈদেশিক ঋণে রিজার্ভ বেড়ে ৩ হাজার কোটি ডলারের রেকর্ড

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে। প্রবাসী আয় ও বিদেশি ঋণের সমন্বয়ে রিজার্ভ ৩০.৫১ বিলিয়ন ডলার বা ৩ হাজার ৫১ কোটি ডলারে পৌঁছেছে, যা দেশের অর্থনীতিতে আশার আলো। বিশেষ করে, গত ১০ মাস ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি না করায় মুদ্রার ওপর চাপ অনেক কমেছে। ঋণ এবং প্রবাসী আয় দুই ক্ষেত্রেই দেশ বড় অগ্রগতি দেখিয়েছে।

প্রবাসী আয় বেড়েছে, রেমিট্যান্সে এসেছে উল্লেখযোগ্য প্রবৃদ্ধি

গত অর্থবছরে (২০২৩-২৪) প্রবাসী আয় ছিল ২৩.৯১ বিলিয়ন ডলার। তবে চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে প্রবাসী আয় প্রায় ২৯.৪৬ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ৬ বিলিয়ন ডলার বেশি। এই প্রবৃদ্ধি দেশের বৈদেশিক মুদ্রার বাজারে স্বস্তি নিয়ে এসেছে।

অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, প্রবাসী আয় বাড়ার পেছনে মূলত অন্তর্বর্তী সরকারের কঠোর অর্থ পাচার বিরোধী পদক্ষেপ এবং বৈধ পথে রেমিট্যান্স পাঠানোর উৎসাহ দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। এতে করে অবৈধ ও কালোবাজারি রোধ পেয়ে বৈধ রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়েছে।

বিদেশি ঋণে রিজার্ভের শক্ত ভিত্তি

আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) সহ অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে আসা ঋণের কারণে রিজার্ভে উল্লেখযোগ্য বাড়তি অর্থ এসেছে। বিশেষ করে, আইএমএফের চলমান ঋণ কর্মসূচির বকেয়া কিস্তি বাবদ ১৩৪ কোটি ডলার, বিশ্বব্যাংকের ৫০ কোটি ডলার ও এডিবির ৯০ কোটি ডলার ঋণ রিজার্ভকে শক্তিশালী করেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, এসব ঋণ দীর্ঘমেয়াদি ও কম সুদের, তাই ভবিষ্যতে দেশের অর্থনীতিতে চাপ বাড়াবে না। বরং এসব অর্থ দিয়ে বাজেট বাস্তবায়ন, ব্যাংক ও রাজস্ব খাত সংস্কারে কাজ করা হবে, যা রপ্তানি ও রাজস্ব আয়ের বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।

ডলারের বাজারে স্বস্তির বাতাস

গত কয়েক বছর ধরে দেশের অর্থনীতিতে ডলার সংকট প্রবল হয়ে দাঁড়িয়েছিল। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব ও বিশ্ববাজারের অস্থিরতার কারণে আমদানি ব্যয় বেড়ে যায়। ডলারের দাম উর্ধ্বমুখী হওয়ায় মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পায় এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় প্রভাব পড়ে।

তবে এখন ডলারের বাজারে স্বস্তির সঙ্কেত দেখা যাচ্ছে। প্রবাসী আয় ও বৈদেশিক ঋণের প্রবাহ বাড়ায় ডলারের সরবরাহ বৃদ্ধি পেয়েছে, যার ফলে ডলারের দাম কিছুটা কমেছে। ব্যাংক ও এক্সচেঞ্জ হাউস থেকে ডলার কেনার খরচও কমেছে, আমদানিকারকদের অতিরিক্ত মূল্য দিতে হচ্ছে না। ফলে আমদানির ক্ষেত্রে চাপ কমেছে।

ঋণ, রেমিট্যান্স ও সংস্কারের সমন্বয়: অর্থনীতির নতুন রূপ

অর্থনীতিবিদ মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, “ডলারের বাজারে স্বস্তি আসা দেশের জন্য বড় সুখবর। তবে আমদানি আরও উন্মুক্ত করতে হবে, যেন ব্যবসা-বাণিজ্য আরও বেগবান হয়। ঋণের মাধ্যমে রিজার্ভ বাড়ানো যায়, কিন্তু ঋণ ফিরিয়ে দিতে হবে, তাই এটি স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধির বিকল্প হতে পারে না।”

তিনি আরও বলেন, “যেহেতু এখন যে ঋণ নেওয়া হচ্ছে তা দীর্ঘমেয়াদি এবং কম সুদের, তাই ভবিষ্যতে রিজার্ভের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হবে না। তবে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সরকারের নেওয়া সংস্কারগুলো সফলভাবে বাস্তবায়ন করা, যা দেশের অর্থনীতি চাঙ্গা করবে।”

গতিশীল অর্থনীতির জন্য প্রয়োজন সংস্কার

বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, দেশের অর্থনৈতিক সঙ্কট কাটাতে সরকারের চলমান ব্যাংক ও রাজস্ব খাত সংস্কার খুবই জরুরি। এই সংস্কারের ফলে দেশের বাজেট বাস্তবায়ন সুগম হবে, আর তা হলে রপ্তানি ও রাজস্ব আয় দুটোই বৃদ্ধি পাবে। এর মাধ্যমে দীর্ঘমেয়াদে অর্থনীতির সুস্থতা নিশ্চিত হবে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি গত কয়েক বছরে নানা সংকটের মধ্য দিয়ে গেলেও, প্রবাসী আয় ও বৈদেশিক ঋণের সমন্বয়ে এখন রিজার্ভের পরিমাণ স্থিতিশীল ও বৃদ্ধি পাচ্ছে। ডলারের বাজারে স্বস্তি আসা, ঋণের মাধ্যমে বাজেট সহায়তা পাওয়া এবং অর্থনীতির বিভিন্ন খাতে সংস্কার চলায় দেশ আগামী দিনগুলোতে আরও শক্ত অবস্থানে পৌঁছাতে পারবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button