অর্থনীতি

রিজার্ভ বৃদ্ধির পিছনে কী কারণ? জানালেন অর্থ উপদেষ্টা

বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বা মুদ্রা মজুত সম্প্রতি বাড়ার পেছনে নানা কারণ রয়েছে। দেশের অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ এই বিষয়টি বিস্তারিত তুলে ধরেছেন। তার বক্তব্য অনুযায়ী, আন্তর্জাতিক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ)বিশ্বব্যাংক থেকে দেওয়া ঋণ ও সাহায্য, রপ্তানি আয়ের উন্নতি এবং প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্সে বৃদ্ধি রিজার্ভ বৃদ্ধির অন্যতম প্রধান কারণ।

আন্তর্জাতিক ঋণ ও আর্থিক সহায়তা রিজার্ভ বৃদ্ধির মূলে

গত সোমবার আইএমএফের পক্ষ থেকে বাংলাদেশকে দেওয়া ঋণের চতুর্থ ও পঞ্চম কিস্তি হিসেবে ১৩৭ কোটি ডলার অনুমোদিত হয়েছে। এছাড়াও, বিশ্বব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) থেকেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ দেশের হাতে এসেছে। এসব অর্থ বাজেট সহায়তা হিসেবে সরকারের হাতে আসায় বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বেড়েছে।

অর্থ উপদেষ্টা জানান, “বাহ্যিক বিনিয়োগের প্রবাহ কিছুটা কম থাকলেও বাজেট সহায়তার কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বৃদ্ধি পাচ্ছে। তাছাড়া রপ্তানি এখন মোটামুটি ভালো এবং রেমিট্যান্সও এসেছে ভালো।”

প্রবাসীদের আস্থা ও রেমিট্যান্সের বৃদ্ধি

সৌদি আরব সফরের অভিজ্ঞতা তুলে ধরে সালেহউদ্দিন বলেন, “সৌদি আরবে সাধারণ প্রবাসীরা এখন আগের চেয়ে বেশি টাকা পাঠাচ্ছেন, কারণ তারা আমাদের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রতি আস্থা রাখতে শুরু করেছে। আগে তারা টাকা পাঠাতে দ্বিধা করতেন। টাকা পাঠানো আর্থিক অস্বস্তির কারণ হত।”

প্রবাসীদের আস্থার এই পরিবর্তন দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে।

অর্থনৈতিক সংস্কার ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, “অর্থনৈতিক সংস্কার মূলত দেশের রাজনীতির ওপর নির্ভরশীল। রাজনীতি সবসময়ই গুরুত্বপূর্ণ। এখন মোটামুটি পরিষ্কার যে নির্বাচনের তারিখ কখন হতে পারে।”

তিনি ব্যবসায়ীদের আস্থা বৃদ্ধি এবং অর্থনীতির স্থিতিশীলতার জন্য সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে বলেও উল্লেখ করেন। বিশেষ করে, ডলারের বিনিময় হার বাজারের নিয়ন্ত্রণে ছেড়ে দেওয়ার পর ব্যবসায়ীদের মধ্যে একপ্রকার উদ্বেগ ছিল, কিন্তু তা কোনো মারাত্মক সমস্যায় পরিণত হয়নি।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সংস্কার ও কর্মচারীদের আন্দোলন

জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের কর্মচারীদের চলমান আন্দোলন এবং এর পেছনের কারণ সম্পর্কে অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “এনবিআর সংস্কারের পথে বাধা দেয়ার জন্য কিছু সুবিধাভোগী ব্যবসায়ী জোরপ্রয়োগ করতে পারে।” তিনি নিশ্চিত করেন, “এনবিআরের কর্মকর্তাদের ক্যারিয়ারে কোনো সমস্যা হবে না। বরং একটি স্বতন্ত্র বিভাগ গঠন করা হবে, যাতে তাদের পদোন্নতি এবং কর্মজীবন আরও উন্নত হবে।”

সালেহউদ্দিন জানান, “এনবিআরের ভেতরে আগে স্বচ্ছতার ঘাটতি ছিল, যার সুযোগ নিয়েছিল আগের সরকারের সময়কার কিছু ব্যবসায়ী।”

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রভাব ও জ্বালানি ব্যবস্থাপনা

বিশ্বের নানা রাজনৈতিক ও সামরিক সংঘাতের মধ্যে অন্যতম ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রভাব বাংলাদেশের ওপর কতটা পড়েছে— এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, “হরমুজ প্রণালী সংক্রান্ত অবরোধ ও যুদ্ধের প্রভাব আমাদের দেশে তেমন পড়েনি। বরং জ্বালানি কেনার ক্ষেত্রে আমরা সাশ্রয় করতে পেরেছি। পুনরায় দরপত্র করায় প্রতি ইউনিট জ্বালানির দাম ৫ থেকে ১০ ডলার পর্যন্ত কমেছে, যার ফলে সরকারের সাশ্রয়ের পরিমাণ প্রায় ৭০ থেকে ৮০ কোটি টাকা।”

তিনি আরও যোগ করেন, “মরক্কো ও তিউনিসিয়ার সারের দাম কিছুটা বেড়েছে, যা আমাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।”

খাদ্য মজুত এবং ক্রয় কমিটির সফলতা

অর্থ উপদেষ্টা জানান, “গত ক্রয় কমিটির বৈঠকে গম কেনার মাধ্যমে প্রায় ১৮ থেকে ২০ কোটি টাকার সাশ্রয় হয়েছে। চাল ও গমের মজুত এখনো সন্তোষজনক অবস্থায় রয়েছে। তবে, নিরাপদ খাদ্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য আমরা ৫০ হাজার টন গম সংরক্ষণের পরিকল্পনা করেছি।”

এটি দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় এক গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ বলে তিনি উল্লেখ করেন।

সামগ্রিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা

বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বৃদ্ধির পেছনে আন্তর্জাতিক আর্থিক সহায়তা, রপ্তানি ও রেমিট্যান্সের ভালো ফলাফল এবং সরকারের নীতিগত পরিবর্তনগুলো ভূমিকা রেখেছে। তবে, অর্থ উপদেষ্টা সতর্ক করেছেন যে দেশের অর্থনীতি ও রিজার্ভের স্থিতিশীলতা পুরোপুরি রাজনীতির সঙ্গে জড়িত।

“ব্যবসায়ীদের আস্থা আরও বাড়ানো এবং নতুন বিনিয়োগ আকৃষ্ট করা সরকারের প্রধান লক্ষ্য। এ জন্য সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে,” বলেন সালেহউদ্দিন আহমেদ।

কী শিক্ষা নেওয়া যায়?

১. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও ঋণ: আইএমএফ, বিশ্বব্যাংক ও এডিবির ঋণ এবং অনুদান দেশের বৈদেশিক মুদ্রার মজুত বাড়াতে গুরুত্বপূর্ণ।
২. রপ্তানি ও রেমিট্যান্স: রপ্তানি ও প্রবাসীদের পাঠানো অর্থ দেশের মুদ্রা রিজার্ভ বৃদ্ধিতে নির্ভরযোগ্য উৎস।
৩. রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা: অর্থনীতির সঠিক সংস্কার এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা অপরিহার্য।
৪. সরকারি পদক্ষেপ ও সংস্কার: এনবিআরের সংস্কার ও স্বচ্ছতা বৃদ্ধির মাধ্যমে কর আদায় বৃদ্ধি এবং দুর্নীতি কমানো সম্ভব।
৫. আন্তর্জাতিক সংকট মোকাবেলা: বিশ্ব বাজারে জ্বালানি ও সার খরচ কমানোর জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।

বাংলাদেশের অর্থনীতি ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ ইতিবাচক পথে এগিয়ে যাচ্ছে। সরকারি উদ্যোগ, আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, ব্যবসায়ীদের আস্থা এবং প্রবাসী অর্থায়নের সমন্বয়ে দেশের অর্থনৈতিক মজবুত ভিত্তি গড়ে উঠছে। তবে, ভবিষ্যতে আরও সুদৃঢ় ও টেকসই অর্থনীতি গড়ে তুলতে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং নীতি-পরিবর্তন অপরিহার্য।

বাংলাদেশের আর্থিক স্বচ্ছতা, কর ব্যবস্থাপনা ও আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি সাশ্রয় উদ্যোগ অবশ্যই দেশের অর্থনৈতিক নিরাপত্তায় বিশেষ ভূমিকা রাখবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button