এলডিসি থেকে উত্তরণ টেকসই করতে জাতীয় ঐক্য প্রয়োজন – ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী

স্বল্পোন্নত দেশের (এলডিসি) তালিকা থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ নিঃসন্দেহে একটি ঐতিহাসিক অর্জন। তবে এই উত্তরণকে টেকসই করতে হলে প্রয়োজন শক্তিশালী অর্থনৈতিক ভিত্তি, সচেতন বেসরকারি খাত এবং সর্বোপরি জাতীয় ঐক্য ও সংহতি। এমনটাই মনে করেন প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী ও অর্থনীতিবিদ ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরী।
গতকাল ময়মনসিংহে আয়োজিত এক কর্মশালায় তিনি বলেন, “উত্তরণের এ যাত্রাকে অর্থবহ করতে হলে আমাদের অর্থনীতিতে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। এজন্য দরকার সবার অংশগ্রহণে একটি জাতীয় ঐক্যের ভিত্তি গড়ে তোলা, যাতে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক শক্তিগুলো সমন্বয় করে উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখতে পারে।”
কর্মশালার আয়োজন ও মূল উদ্দেশ্য
অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অধীন সাপোর্ট টু সাসটেইনেবল গ্র্যাজুয়েশন প্রকল্প (এসএসজিপি)-এর উদ্যোগে কর্মশালাটি অনুষ্ঠিত হয় ময়মনসিংহে। এতে স্থানীয় প্রশাসনসহ বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি খাতের প্রতিনিধিরা অংশ নেন। আয়োজনের সহযোগিতায় ছিল ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসন। সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, এসএসজিপির আওতায় এই কর্মশালার মূল উদ্দেশ্য ছিল এলডিসি উত্তরণ-পরবর্তী চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা বিষয়ে স্থানীয় অংশীজনদের সচেতন করা এবং তাদের প্রস্তুতিমূলক ভূমিকা নিশ্চিত করা।
কর্মশালায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে ড. আনিসুজ্জামান বলেন, “উন্নয়ন তখনই টেকসই হয়, যখন তা সবার অংশগ্রহণে হয়। শুধু কেন্দ্রীয় পর্যায়ের সিদ্ধান্ত যথেষ্ট নয়; স্থানীয় পর্যায়ের উদ্যোগ, উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন ক্ষমতাই দেশকে সামনে এগিয়ে নেয়।”
সরকারি কর্মকর্তাদের বক্তব্য
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন ময়মনসিংহ বিভাগের বিভাগীয় কমিশনার মো. মোখতার আহমেদ। তিনি বলেন, “আমরা অতীতে বহু চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করেছি। করোনা মহামারির সময় থেকে শুরু করে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট– সব কিছুতে বেসরকারি খাতের উদ্ভাবনী শক্তি ও আত্মবিশ্বাস আমাদের টিকিয়ে রেখেছে। এই শক্তিই এখন কাজে লাগিয়ে এলডিসি উত্তরণজনিত নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে।”
ময়মনসিংহ জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম বলেন, “ময়মনসিংহ কৃষি, মৎস্য এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে সমৃদ্ধ একটি অঞ্চল। প্রযুক্তিনির্ভর উৎপাদন, মান নিয়ন্ত্রণ, ব্র্যান্ডিং ও বাজার সংযোগের মাধ্যমে এখানকার সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে হবে। শুধুমাত্র সম্ভাবনার কথা বললে হবে না, বাস্তবায়নই এখন মূল চাবিকাঠি।”
এসএসজিপি প্রকল্পের দিকনির্দেশনা
কর্মশালার শুরুতে স্বাগত বক্তব্যে ইআরডির অতিরিক্ত সচিব ও এসএসজিপি প্রকল্প পরিচালক এএইচএম জাহাঙ্গীর বলেন, “এলডিসি থেকে উত্তরণ আমাদের জন্য যেমন গর্বের, তেমনি এটি নতুন কিছু বাধা ও দায়িত্বের সূচনাও। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার সীমিত হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বাড়বে। এই প্রেক্ষাপটে বেসরকারি খাতকে প্রস্তুত করতে সচেতনতা ও পরিকল্পনা জরুরি।”
তিনি আরও বলেন, “রপ্তানির পণ্যের বৈচিত্র্য, টেকসই উৎপাদন ব্যবস্থা, মানসম্পন্ন পণ্য তৈরি এবং বৈশ্বিক চাহিদা অনুযায়ী নিজেকে খাপ খাইয়ে নেওয়াই এখন আমাদের উন্নয়নের নতুন কৌশল হওয়া উচিত।”
জাতীয় ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা
ড. আনিসুজ্জামান চৌধুরীর বক্তব্যে মূল গুরুত্ব পেয়েছে জাতীয় ঐক্য ও সংহতির বিষয়টি। তিনি বলেন, “উন্নয়ন কখনও এককভাবে সম্ভব নয়। রাজনৈতিক মতভেদ থাকতেই পারে, কিন্তু উন্নয়নের প্রশ্নে আমাদের এক প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে। এলডিসি থেকে উত্তরণ কেবল একটি প্রশাসনিক বা অর্থনৈতিক সূচক নয়, এটি একটি দায়িত্বও। এ দায়িত্ব পালনে সরকার, ব্যবসায়ী, শিল্পোদ্যোক্তা, এনজিও, শিক্ষাবিদ ও তরুণদের সক্রিয়ভাবে যুক্ত হতে হবে।”
তিনি আরও বলেন, “দেশের উন্নয়ন কেবল রাজধানীকেন্দ্রিক হলে হবে না। ময়মনসিংহের মতো সম্ভাবনাময় অঞ্চলগুলোকে সম্পৃক্ত করতে হবে। একটি ভারসাম্যপূর্ণ উন্নয়ন পরিকল্পনার মাধ্যমেই টেকসই উত্তরণ সম্ভব।”
স্থানীয় উন্নয়ন ও বৈচিত্র্যের কথা
ময়মনসিংহ অঞ্চলের কৃষিপণ্য, দুগ্ধ শিল্প, মৎস্য খামার এবং পর্যটনের অপার সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করে বক্তারা বলেন, “এই অঞ্চলকে কেন্দ্র করে একটি বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তোলা যেতে পারে, যেখানে স্থানীয় উৎপাদনের পাশাপাশি রপ্তানিযোগ্য পণ্যও তৈরি হবে।”
কর্মশালায় আলোচনার একটি উল্লেখযোগ্য দিক ছিল, স্থানীয় প্রশাসনের দক্ষতা ও সক্ষমতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তা। জেলা প্রশাসক মুফিদুল আলম বলেন, “কেন্দ্রীয় নীতির বাস্তবায়নে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে স্থানীয় প্রশাসন। তাই তাদের জন্য নির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তিগত সহায়তা এবং পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ নিশ্চিত করা জরুরি।”
ভবিষ্যতের করণীয়
বক্তারা মনে করেন, এলডিসি থেকে উত্তরণ কেবল আন্তর্জাতিক মর্যাদার বিষয় নয়, এটি বাংলাদেশের অর্থনীতিতে মৌলিক পরিবর্তনের সুযোগ এনে দিয়েছে। এখন প্রয়োজন একটি সুসংহত কৌশল, যাতে করে রপ্তানি বাজার ধরে রাখা যায়, নতুন বাণিজ্য চুক্তি করা যায়, এবং অর্থনৈতিক নীতিতে স্বচ্ছতা ও স্থায়িত্ব নিশ্চিত করা যায়।
ড. আনিসুজ্জামান বলেন, “আমাদের নিজেদের উৎপাদন, শ্রমবাজার, দক্ষতা উন্নয়ন এবং শিক্ষা ব্যবস্থার উন্নয়ন ঘটিয়ে বিশ্ববাজারে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হবে। আর এই জন্য চাই সমন্বিত পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নের সাহস।”
উপসংহার
এলডিসি থেকে বাংলাদেশের উত্তরণ নিঃসন্দেহে একটি যুগান্তকারী সাফল্য। তবে এই উত্তরণকে টেকসই ও কার্যকর করতে হলে কেবল ঢাকাভিত্তিক পরিকল্পনায় নয়, বরং সারাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন ও সংহতির ওপর জোর দিতে হবে। কর্মশালায় উপস্থাপিত ভাবনা ও প্রস্তাবনা বাস্তবায়িত হলে শুধু ময়মনসিংহ নয়, গোটা বাংলাদেশই উপকৃত হবে।