অর্থনীতি

রিজার্ভ ছাড়াল ২৭ বিলিয়ন ডলার: অর্থনীতিতে স্বস্তির ইঙ্গিত

দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আবারও ২৭ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) থেকে ঋণের কিস্তি ছাড় এবং প্রবাসীদের রেমিট্যান্স প্রবাহ বৃদ্ধির ফলে এই অগ্রগতি সম্ভব হয়েছে। এতে অর্থনীতিতে কিছুটা স্বস্তি ফিরে এসেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।

আইএমএফ-এর ঋণ ছাড় ও রেমিট্যান্স প্রবাহে রিজার্ভে বড় লাফ

বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্যমতে, দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার (গ্রস রিজার্ভ)। বিগত কয়েক মাসের তুলনায় এটি একটি উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি।

এই বৃদ্ধি সম্ভব হয়েছে মূলত আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (IMF) কাছ থেকে একসঙ্গে দুটি কিস্তিতে মোট ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ঋণ ছাড়ের ফলে। পাশাপাশি, সাম্প্রতিক সময়ে মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশ থেকে পাঠানো রেমিট্যান্সের প্রবাহও বেড়েছে, যা রিজার্ভ বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়েছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র আরিফ হোসেন খান সাংবাদিকদের জানান, “এই বৃদ্ধি সাময়িক হলেও দেশের বৈদেশিক লেনদেনের সক্ষমতা কিছুটা বাড়াবে।”

রিজার্ভের অগ্রগতির পেছনের পটভূমি

২০২১ সালের আগস্টে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ রেকর্ড ৪৮ দশমিক ০৪ বিলিয়ন ডলার স্পর্শ করেছিল। তবে ২০২২ সালের পর থেকে বৈশ্বিক ডলার সংকট, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ, আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার কারণে ধারাবাহিকভাবে রিজার্ভ হ্রাস পেতে থাকে

২০২৩ এবং ২০২৪ সালে পরিস্থিতি আরও জটিল হয় যখন আমদানি ব্যয় মেটাতে রিজার্ভের উপর অতিরিক্ত চাপ পড়ে। ফলে ২০২৫ সালের শুরুর দিকে রিজার্ভ ২৫ বিলিয়নের নিচে নেমে গিয়েছিল।

তবে সরকার এবং কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একাধিক পদক্ষেপ— যেমন রপ্তানিকারকদের জন্য প্রণোদনা, হুন্ডি প্রতিরোধে কঠোর মনিটরিং ও বৈধ চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুবিধা বৃদ্ধি—এই সংকট উত্তরণে ভূমিকা রেখেছে।

গ্রস বনাম BPM6 রিজার্ভ: পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ

বর্তমানে গ্রস রিজার্ভ দাঁড়ালেও ২৭ দশমিক ৩১ বিলিয়নে, BPM6 মান অনুযায়ী এই সংখ্যা কিছুটা কম — ২২ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার

গ্রস রিজার্ভ হলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের মোট বৈদেশিক মুদ্রার মজুত, যেখানে BPM6 (Balance of Payments Manual 6) অনুযায়ী হিসাব করলে শুধুমাত্র তা-ই ধরা হয় যা আন্তর্জাতিক লেনদেনের জন্য অবিলম্বে ব্যবহারযোগ্য।

এবং এই BPM6 রিজার্ভই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য।

অর্থনীতির ওপর প্রভাব ও বিশেষজ্ঞ মতামত

বিশেষজ্ঞদের মতে, রিজার্ভ বাড়ার এই ধারা অব্যাহত থাকলে আমদানি ব্যয় নির্বাহে চাপ কমবে এবং মুদ্রার বিনিময় হার স্থিতিশীল থাকবে। এছাড়া, বৈদেশিক ঋণের কিস্তি পরিশোধ ও জরুরি প্রয়োজন মেটাতে সক্ষমতা বাড়বে।

অর্থনীতিবিদ ড. সাইফুল ইসলাম বলেন, “রিজার্ভের এই বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে স্বস্তিদায়ক, তবে এটি টেকসই করতে হলে রপ্তানি আয় বাড়ানো, বিনিয়োগে স্বচ্ছতা ও রেমিট্যান্স চ্যানেল শক্তিশালী করতে হবে।”

চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে

যদিও রিজার্ভ বাড়ার এই খবর স্বস্তির, তবুও বাস্তবতা হলো, বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ তিন মাসের আমদানি ব্যয় কভার করার কাছাকাছি, যা বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফ-এর মতে একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থান।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই বৃদ্ধিকে যেন “বিপদ কেটেছে” হিসেবে না ধরা হয়। কারণ ঋণ ছাড় একবারে হয়, তবে আমদানি ব্যয়, ঋণ পরিশোধ ও ডলার সংকট চলমান।

উপসংহার: সামনে কী আছে?

বাংলাদেশ ব্যাংক এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের সম্মিলিত পদক্ষেপে রিজার্ভে সাময়িক স্বস্তি এলেও এটি যে দীর্ঘস্থায়ী সমাধান নয়, সে বিষয়ে অনেকেই একমত।

প্রবৃদ্ধি ধরে রাখতে হলে উৎপাদন, রপ্তানি, বৈদেশিক বিনিয়োগ এবং দক্ষ জনশক্তি রপ্তানিতে আরও মনোযোগ দিতে হবে। একই সঙ্গে বৈধ পথে রেমিট্যান্স বাড়ানোর উদ্যোগ আরও জোরদার করতে হবে।

তবে প্রশ্ন থেকেই যায়: এই রিজার্ভ কি নতুন স্থিতিশীলতার সূচক, নাকি সাময়িক আরাম? বিশ্লেষকরা বলছেন, সময়ই এর উত্তর দেবে।
এম আর এম – ০০৩৯, Signalbd.com

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button