অর্থনীতি

বেনাপোল কাস্টম হাউসে কলমবিরতি, আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রমে বিঘ্ন

যশোরের গুরুত্বপূর্ণ স্থলবন্দর বেনাপোল কাস্টম হাউসে আবারও কলমবিরতির কর্মসূচি পালিত হয়েছে, যার ফলে সোমবার সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত স্থবির হয়ে পড়ে আমদানি-রপ্তানি কার্যক্রম। এনবিআরের গঠনপুনর্বিন্যাস ও প্রশাসনিক সংস্কারের প্রতিবাদে কাস্টমস কর্মকর্তাদের এই কর্মসূচি চলমান থাকায় চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন আমদানি-রপ্তানিকারক ব্যবসায়ী ও পণ্য খালাসকারী প্রতিষ্ঠানগুলো।

সোমবার (২৩ জুন) সকাল ৯টা থেকে দুপুর ১২টা পর্যন্ত তিন ঘণ্টার এই কলমবিরতির কর্মসূচিতে কোনো আমদানি-রপ্তানি সংক্রান্ত নথিপত্রে স্বাক্ষর দেননি কাস্টমস কর্মকর্তারা। ফলে পণ্যের শুল্কায়ন এবং বন্দরের অন্যান্য কার্যক্রম থমকে দাঁড়ায়।

কলমবিরতির পেছনের প্রেক্ষাপট

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) সম্প্রতি গৃহীত সংস্কার পরিকল্পনার আওতায় এনবিআরকে দুই ভাগ করার অধ্যাদেশ জারি করে সরকার। এই সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে কাস্টমস, ভ্যাট ও আয়কর বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা ‘এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদ’ ব্যানারে সংগঠিত হয়ে আন্দোলনে নামেন।

পূর্বেও মে মাসে একই ধরনের কর্মসূচি পালিত হয়। পরবর্তীতে অর্থ মন্ত্রণালয় ২৫ মে রাতে এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, এনবিআরকে বিলুপ্ত করা হচ্ছে না বরং এটিকে একটি ‘স্বাধীন ও বিশেষায়িত প্রতিষ্ঠান’ হিসেবে উন্নীত করা হচ্ছে। তখন আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত হলেও আবারও কলমবিরতি কর্মসূচি শুরু হয়েছে।

বেনাপোল কাস্টম হাউসে সোমবারের পরিস্থিতি

সোমবার সকাল ৯টা থেকে বেনাপোল কাস্টম হাউসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা চেয়ারে না বসে কর্মবিরতি পালন করেন। কেউ কোনো কাগজে স্বাক্ষর দেননি, কোনো ফাইল প্রক্রিয়াকরণ হয়নি, এবং পণ্যের শুল্কায়ন বন্ধ ছিল। ফলে ভারতে থেকে পণ্য এনে বন্দর এলাকায় আটকে পড়ে অনেক পণ্যবাহী ট্রাক।

বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০০-৬০০ ট্রাক পণ্য আমদানি-রপ্তানি হয়। তবে কর্মসূচির কারণে দিনের প্রথমার্ধে কার্যক্রম প্রায় সম্পূর্ণভাবে বন্ধ থাকে। দুপুর ১২টার পর কিছুটা স্বাভাবিকতা ফিরে এলেও ব্যাংকিং সময়সীমা পার হওয়ায় অনেক পণ্যের শুল্ক জমা দেওয়া সম্ভব হয়নি, ফলে সেগুলোর খালাস কার্যক্রমও আটকে পড়ে।

ব্যবসায়ীদের দুর্ভোগ

বন্দর ব্যবহারকারী ও সিএন্ডএফ (C&F) এজেন্টরা জানিয়েছেন, দিনের অর্ধেক সময় কাস্টম কার্যক্রম বন্ধ থাকায় তাঁদের ব্যবসায়িক কার্যক্রম মারাত্মকভাবে ব্যাহত হয়েছে।

মতিয়ার রহমান নামে এক আমদানিকারক বলেন, “কলমবিরতির কারণে আমাদের একাধিক চালানের কাজ আটকে গেছে। দুপুরের পর স্বাক্ষর পেলেও ব্যাংক তো বিকেল ৪টার পর টাকা জমা নেয় না। এতে পুরো দিন নষ্ট হয়ে যায়। প্রতিদিন এমন হলে আমাদের পণ্য খালাসে দীর্ঘসূত্রতা বাড়বে, যার প্রভাব পড়বে ব্যবসা ও আর্থিক ক্ষতির ওপর।”

একজন সিএন্ডএফ প্রতিনিধি বলেন, “আমরা সকালেই পণ্য ছাড়ের জন্য সব প্রস্তুতি নিয়েছিলাম। কিন্তু কর্মকর্তারা চেয়ারে না বসায় ফাইল জমা দিতে পারিনি। দুপুরের পরে স্বাক্ষর পেলেও লেট ফাইন, হ্যান্ডলিং চার্জ, ডেমারেজ – সব মিলিয়ে বাড়তি খরচ গুনতে হয়।”

কাস্টমস কর্তৃপক্ষের অবস্থান

বেনাপোল কাস্টম হাউসের একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, “এটি কেন্দ্রীয় কর্মসূচির অংশ। আমরা বাধ্য হয়ে কর্মসূচি পালন করছি, না হলে দলছুট হয়ে যাব। তবে দুপুরের পর সব ফাইলে স্বাক্ষর দিয়ে দিচ্ছি। কোনো ফাইল দিনশেষে পেন্ডিং থাকবে না।”

তবে বাস্তব অভিজ্ঞতা বলছে, শুধু স্বাক্ষর করলেই হয় না, শুল্ক জমা, চালান হালনাগাদ, ব্যাংকিং কার্যক্রম—সব মিলিয়ে একদিনে পুরো প্রক্রিয়া শেষ হওয়া সম্ভব হয় না। ফলে রয়ে যায় দীর্ঘসূত্রতা ও পণ্য খালাসে জট।

চাপ বাড়ছে আমদানি-রপ্তানির ওপর

বেনাপোল স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে শিল্প কাঁচামাল, ফলমূল, রাসায়নিক দ্রব্যসহ নানা রকম পণ্য আমদানি হয়। আবার বাংলাদেশ থেকে পোশাক, পাটজাত দ্রব্য, হিমায়িত মাছসহ অনেক পণ্য রপ্তানি হয় ভারতে।

এই স্থলবন্দরের কার্যক্রমে প্রতিদিন শত কোটি টাকার পণ্য লেনদেন হয়। ফলে কর্মসূচির কারণে আমদানি-রপ্তানির গতি কমে যাওয়ায় জাতীয় অর্থনীতিতেও প্রভাব পড়ার আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে।

শুল্ক গেটের এক কর্মচারী বলেন, “কাস্টমস যদি সকালে কাজ না করে, তাহলে বন্দরের অন্যান্য বিভাগও অলস হয়ে পড়ে। এতে দিনের অর্ধেক কার্যক্রম স্থবির হয়ে যায়।”

নতুন করে আশঙ্কা: স্থায়ী কর্মসূচি হলে কী হবে?

বিশ্লেষকরা বলছেন, এনবিআর সংস্কার নিয়ে যদি দ্রুত আলোচনার মাধ্যমে সমাধান না আসে, তাহলে কলমবিরতির পরিধি ও মেয়াদ আরও বাড়তে পারে। এতে স্থায়ীভাবে আমদানি-রপ্তানির গতি কমে যাবে এবং দেশের বাণিজ্যক্ষেত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

এনবিআর সংস্কার ঐক্য পরিষদের এক নেতা নাম না প্রকাশ করার শর্তে বলেন, “আমরা চাই যুক্তিসংগত সংস্কার, কিন্তু তা হতে হবে অংশগ্রহণমূলক আলোচনার ভিত্তিতে। একতরফাভাবে গৃহীত সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের চেষ্টা করলে এর প্রতিবাদ চলবেই।”

অন্যদিকে ব্যবসায়ী সংগঠনগুলো বলছে, “এনবিআরের ভেতরের সংকট নিয়ে আমদানি-রপ্তানিকারকরা ভুক্তভোগী হতে পারেন না। সরকার ও কর্মকর্তাদের উচিত দ্রুত আলোচনায় বসে সুষ্ঠু সমাধান খোঁজা।”

উপসংহার

বেনাপোল কাস্টম হাউসের কলমবিরতির মতো কর্মসূচি শুধু প্রশাসনিক চাপ নয়, এর পরোক্ষ ফল পড়ে দেশের অর্থনীতি, বাণিজ্যিক প্রবাহ এবং সাধারণ ব্যবসায়ীদের ওপর। ত্বরিত আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধান না হলে স্থায়ীভাবে আমদানি-রপ্তানিতে ধীরগতি ও অর্থনৈতিক ক্ষতির মুখোমুখি হতে পারে দেশ।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button