বাজেট সহায়তায় এআইআইবি’র ৪০ কোটি ডলার পেল বাংলাদেশ

বাংলাদেশকে এশীয় অবকাঠামো বিনিয়োগ ব্যাংক (এআইআইবি) থেকে ৪০ কোটি মার্কিন ডলার বাজেট সহায়তা হিসেবে ঋণ অনুমোদন করা হয়েছে। ‘ক্লাইমেট রেসিলিয়েন্স ইনক্লুসিভ ডেভেলপমেন্ট’ কর্মসূচির আওতায় এই ঋণ মূলত বাংলাদেশের বাজেট ঘাটতি পূরণে এবং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় সক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে।
প্রতি ডলারের বিনিময় মূল্য ১২২.২০ টাকা ধরে এই ঋণের পরিমাণ দেশীয় মুদ্রায় প্রায় ৪ হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা রক্ষায় এবং পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে আশা করা হচ্ছে।
ঋণচুক্তি স্বাক্ষর: একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক
সোমবার (২৩ জুন) ঢাকায় বাংলাদেশ সরকার এবং এআইআইবি’র মধ্যে এই ঋণচুক্তি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হয়। বাংলাদেশের পক্ষে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) অতিরিক্ত সচিব মিরানা মাহরুখ এবং এআইআইবি’র পক্ষে ভারপ্রাপ্ত প্রধান বিনিয়োগ কর্মকর্তা রজত মিশ্রা চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। এই চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানটি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের গুরুত্বকে আবারও তুলে ধরলো।
চুক্তি স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে মিরানা মাহরুখ বলেন, “এই ঋণ সহায়তা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সময়োপযোগী। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় আমাদের সক্ষমতা বাড়ানো এবং জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমনমূলক কার্যক্রমে গতি আনা এখন সময়ের দাবি। এই ঋণ আমাদের সেই লক্ষ্য অর্জনে সহায়ক হবে।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, এই ঋণ পরিবেশবান্ধব নীতিমালা সংস্কারের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনীতি গঠনে সরকারের অঙ্গীকারকে শক্তিশালী করবে।
অন্যদিকে, রজত মিশ্রা তার বক্তব্যে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং জলবায়ু পরিবর্তনের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারের প্রচেষ্টার প্রশংসা করেন। তিনি বলেন, “এআইআইবি বাংলাদেশের উন্নয়নের দীর্ঘদিনের অংশীদার। জলবায়ু সহনশীল উন্নয়ন এবং পরিবেশবান্ধব অর্থনীতি গড়ে তোলার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়াতে পেরে আমরা আনন্দিত। এই ঋণ কর্মসূচি জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করবে এবং একটি সবুজ ও টেকসই ভবিষ্যৎ নির্মাণে সহায়তা করবে।”
ঋণের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য
এই ঋণ কর্মসূচির মূল লক্ষ্য হলো জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবিলায় বাংলাদেশের সক্ষমতা বৃদ্ধি করা। বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব ক্রমবর্ধমান হারে পরিলক্ষিত হচ্ছে, এবং বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, খরা, এবং সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি বাংলাদেশের কৃষি, অর্থনীতি, এবং জনজীবনের ওপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। এই প্রেক্ষাপটে, এআইআইবি’র এই ঋণ সহায়তা জলবায়ু অভিযোজন ও প্রশমনমূলক কার্যক্রমে গতি আনবে।
ঋণচুক্তির অন্যতম প্রধান শর্ত হলো, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ এবং উন্নয়ন কার্যক্রম জোরদার করবে। এর মধ্যে রয়েছে:
- জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো নির্মাণ: বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ, ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্র, উন্নত সেচ ব্যবস্থা, এবং লবণাক্ততা প্রতিরোধী অবকাঠামো নির্মাণ ও সংস্কারে এই অর্থ ব্যয় করা হবে।
- সবুজ প্রযুক্তি ও নবায়নযোগ্য শক্তি: নবায়নযোগ্য শক্তির উৎস যেমন সৌরবিদ্যুৎ এবং বায়ুবিদ্যুৎ উৎপাদনে বিনিয়োগ বাড়ানো হবে। পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার উৎসাহিত করা হবে।
- জলবায়ু অভিযোজন কর্মসূচি: কৃষি খাতে জলবায়ু সহনশীল ফসলের জাত উদ্ভাবন, উন্নত কৃষি পদ্ধতি প্রবর্তন, এবং প্রান্তিক কৃষকদের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপ খাইয়ে চলার প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে।
- পরিবেশবান্ধব নীতিমালা সংস্কার: সরকারের নীতি ও আইন সংস্কার করে পরিবেশ সুরক্ষা এবং টেকসই উন্নয়নে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। শিল্পখাতে পরিবেশবান্ধব উৎপাদন প্রক্রিয়া উৎসাহিত করা হবে।
পাশাপাশি, এই ঋণ পরিবেশবান্ধব নীতিমালা সংস্কারের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক ও টেকসই অর্থনীতি গঠনের লক্ষ্যও পূরণ করবে। এর অর্থ হলো, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের সময় পরিবেশের সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দেওয়া হবে এবং সমাজের সকল স্তরের মানুষের জন্য উন্নয়নের সুফল নিশ্চিত করা হবে।
পরিশোধের শর্তাবলী
এই ঋণের পরিশোধের শর্তাবলী বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত সুবিধাজনক। এই ঋণ ৫ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ মোট ৩৫ বছরে পরিশোধযোগ্য। গ্রেস পিরিয়ড হলো এমন একটি সময়কাল যেখানে ঋণগ্রহীতাকে মূল ঋণের কিস্তি পরিশোধ করতে হয় না, শুধুমাত্র সুদ পরিশোধ করা হয়। এই দীর্ঘ পরিশোধকাল বাংলাদেশের অর্থনীতিতে চাপ কমাবে এবং প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য পর্যাপ্ত সময় দেবে।
সুদহার হিসেবে এককালীন ০.২৫ শতাংশ হারে ফি পরিশোধ করতে হবে, যা আন্তর্জাতিক ঋণের ক্ষেত্রে একটি অত্যন্ত অনুকূল হার। এই শর্তাবলী বাংলাদেশের বাজেট ব্যবস্থাপনা এবং দীর্ঘমেয়াদী উন্নয়নের জন্য ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে।
সরকারের প্রত্যাশা ও এর প্রভাব
সরকার আশা করছে, এই ঋণ কর্মসূচির মাধ্যমে জলবায়ু সহনশীল অবকাঠামো ও উন্নয়ন কার্যক্রমে গতি আসবে এবং বাজেট ঘাটতি সামাল দিতেও এটি সহায়ক হবে। বাংলাদেশের বার্ষিক বাজেটে উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে প্রায়শই অর্থের প্রয়োজন হয়, এবং এই ঋণ সেই ঘাটতি পূরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এআইআইবি’র এই ৪০ কোটি ডলারের ঋণ দেশের অর্থনীতিতে একটি ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বিশেষ করে, এটি বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ শক্তিশালী করতে এবং মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সহায়ক হতে পারে। এছাড়াও, জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত প্রকল্পগুলিতে বিনিয়োগ বৃদ্ধির ফলে দেশের কৃষি উৎপাদন, অবকাঠামো এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে।
জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত আন্তঃসরকার প্যানেল (আইপিসিসি) এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই পরিস্থিতিতে, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছ থেকে এমন আর্থিক সহায়তা বাংলাদেশের জন্য অত্যন্ত জরুরি। এই ঋণ শুধুমাত্র আর্থিক সহায়তা নয়, বরং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে বাংলাদেশের অংশীদারিত্বের একটি প্রতীকও বটে।
সব মিলিয়ে, এআইআইবি’র এই বাজেট সহায়তা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং জলবায়ু সহনশীল উন্নয়নের পথে একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। এটি বাংলাদেশের জনগণের জন্য একটি নিরাপদ ও উন্নত ভবিষ্যৎ নির্মাণে সহায়ক হবে বলে আশা করা হচ্ছে।