অর্থনীতি

আগামী পাঁচ বছরে আইসিটি পণ্য রপ্তানি ৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে

দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতে আগামী পাঁচ বছরের মধ্যে রপ্তানি ৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে পৌঁছাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন ডাক, টেলিযোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিষয়ক প্রধান উপদেষ্টা ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব।

ষষ্ঠবারের মতো আয়োজিত দুই দিনব্যাপী বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও) সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয় রাজধানীর মিরপুর সেনা প্রাঙ্গণে, যেখানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সহযোগিতায় এবং বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বিজনেস প্রোমোশন কাউন্সিলের সহায়তায় বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অব কনট্যাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্কো) আয়োজিত।

আইসিটির বিকাশে দৃঢ় সংকল্প ও আধুনিক প্রণোদনা

ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব জানান, ‘২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশের আইসিটি পণ্যের রপ্তানি ৫০০ কোটি মার্কিন ডলারে উন্নীত হবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আগামী ১৫ জুলাইয়ের মধ্যে ব্যক্তিগত তথ্য সুরক্ষা আইনের খসড়া উপদেষ্টা পরিষদের কাছে উপস্থাপন করা হবে। এর ফলে ভবিষ্যতে তথ্যপ্রযুক্তি খাতে ইউরোপীয় বাজারে প্রবেশে কোনো প্রতিবন্ধকতা থাকবে না।’

সরকার বর্তমানে পেমেন্ট গেটওয়ে ব্যবস্থায় বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। গুগল পে চালু করা হয়েছে, আর ‘স্ট্রিপ’ পেমেন্ট গেটওয়ের সঙ্গে আলোচনা চলছে। এছাড়া ‘পে পাল’ ব্যবস্থাও আনয়নের জন্য কাজ চলছে। এর ফলে আইসিটি খাতের সেবাদান আরও দ্রুততর ও সহজতর হবে।

সফটওয়্যার পার্ক নির্মাণে ব্যাপক উদ্যোগ

ঢাকায় নতুন সফটওয়্যার পার্ক তৈরির ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকাসহ আশপাশের বিভিন্ন স্থানে যেমন কামরাঙ্গীরচর, মিরপুর ও তেজগাঁওয়ে নতুন সফটওয়্যার পার্ক নির্মাণ করা হবে। পূর্বাচলে একটি হাইটেক সফটওয়্যার পার্কও নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এসব সফটওয়্যার পার্ক প্রতিষ্ঠিত হলে আইসিটি খাতে কর্মরত প্রতিষ্ঠানগুলোকে কম খরচে অফিস সুবিধা প্রদান করা সম্ভব হবে।

ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার: সরকারের নতুন অগ্রাধিকার

দেশে বহু ডিজিটাল উদ্যোগ থাকলেও সেগুলোর মধ্যে সমন্বয়ের অভাব ছিল। একেকটি উদ্যোগ বিচ্ছিন্ন ডিজিটাল আইল্যান্ড হিসেবে কাজ করছিল। তাই সরকার এখন ‘ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার’ (ডিপিআই) গড়ে তোলার উদ্যোগ নিয়েছে, যা দেশের ডিজিটাল সেবার একক সমাধান হবে।

ফয়েজ আহমেদ তৈয়্যব আরও জানান, সরকার ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) খাতকে অগ্রাধিকার দিচ্ছে এবং প্রচলিত খাতগুলোর থেকে প্রণোদনা কমিয়ে এসব আধুনিক খাতে বৃদ্ধি করার পরিকল্পনা রয়েছে।

শিল্প মন্ত্রণালয়ের দৃষ্টি: সমন্বিত নীতি ও আধুনিক অবকাঠামো

সম্মেলনের প্রধান অতিথি, শিল্প ও গৃহায়ণ ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আদিলুর রহমান খান বলেন, ‘বিপিও শিল্পের সবচেয়ে বড় শক্তি হলো এর অন্তর্নিহিত সম্ভাবনা। তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর সেবা খাতের উন্নয়নে প্রয়োজন সমন্বিত নীতি, আধুনিক অবকাঠামো ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের পূর্ণ সমর্থন। আমরা স্মার্ট নগর পরিকল্পনা, আইটি পার্ক এবং আধুনিক অফিস অবকাঠামো উন্নয়নে প্রযুক্তিনির্ভর দৃষ্টিভঙ্গিকে গুরুত্ব দিচ্ছি।’

নাগরিক সেবায় তথ্যপ্রযুক্তির ভূমিকা

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের সচিব শীষ হায়দার চৌধুরী বলেন, ‘আমরা নাগরিক সেবায় “ওয়ান স্টপ সার্ভিস” নিশ্চিত করতে দেশের বিভিন্ন স্থানে নাগরিক সেবাকেন্দ্র স্থাপন করছি। এটি সরকার ও জনগণের মধ্যে সেতুবন্ধনের কাজ করবে এবং তথ্যপ্রযুক্তি খাতকে এগিয়ে নেবে।’

ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজির বৈশ্বিক বাজার: বিশাল সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জ

তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবু সাঈদ উল্লেখ করেন, জাতিসংঘ সংস্থা আঙ্কটাডের তথ্য অনুযায়ী, ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি বাজার বর্তমানে ২.৫ ট্রিলিয়ন ডলার এবং প্রতি বছর গড়ে ২০ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০৩৩ সালে এটি ১৬.৪ ট্রিলিয়ন ডলারে পৌঁছাবে। আমাদের প্রশ্ন হলো, আমরা এই বিশাল বাজারের কতটুকু অংশ নিতে পারব এবং আমাদের সক্ষমতা কতটা? সেটাই এখন মূল চ্যালেঞ্জ।

তরুণদের প্রযুক্তিভিত্তিক কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা সৃষ্টি

বাক্কো সভাপতি তানভীর ইব্রাহীম বলেন, ‘বিপিও সামিট শুধু একটি শিল্পের সম্মেলন নয়, এটি দেশের তরুণদের প্রযুক্তিভিত্তিক কর্মসংস্থান ও উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।’

বিপিও সম্মেলনের কর্মসূচি ও প্রযুক্তি প্রদর্শনী

দুই দিনব্যাপী এই সম্মেলনে ৯টি সেমিনার ও কর্মশালা অনুষ্ঠিত হয়। থাকছে চাকরি মেলা এবং উদ্যোক্তা বিষয়ক বিশেষ অধিবেশন। দেশি-বিদেশি প্রযুক্তি ও বিপিও প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণে পণ্য ও সেবা প্রদর্শনী সাজানো হয়েছে।

আসা দর্শনার্থীরা সরাসরি স্টারলিংক স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ব্যবহারের অভিজ্ঞতা নিতে পারবেন। এ ছাড়াও, এই সম্মেলনে জুলাই অভ্যুত্থানকে কেন্দ্র করে নির্মিত অগমেন্টেড রিয়েলিটি (এআর) ও ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (ভিআর) প্রযুক্তি প্রদর্শনী রয়েছে। ড্রোন, সাবমেরিন প্রযুক্তি ও রোবট প্রদর্শনীর মাধ্যমে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির চিত্র তুলে ধরা হয়েছে।

দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং সরকার বিভিন্ন পরিকল্পনা ও নীতি গ্রহণের মাধ্যমে এটিকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে উন্নীত করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। ৫ বিলিয়ন ডলারের রপ্তানির লক্ষ্য পূরণের পথে বাংলাদেশ ডিজিটাল প্রযুক্তিতে নতুন দিগন্ত সৃষ্টি করছে। সফটওয়্যার পার্ক, আধুনিক অবকাঠামো, তথ্য সুরক্ষা আইনসহ নানা উদ্যোগ দেশের আইসিটি খাতকে বিশ্বমানের অবস্থানে নিয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button