অর্থনীতি

চালের বাজারে আগুন: এক সপ্তাহে কেজিতে ৮ টাকা পর্যন্ত মূল্যবৃদ্ধি

সদ্য ঈদুল আযহার আনন্দ কাটতে না কাটতেই দেশের বাজারে চালের দাম বেড়ে গেছে হঠাৎ করেই। রাজধানীসহ সারা দেশের বাজারে এক সপ্তাহের ব্যবধানে মিনিকেট চালের দাম কেজিতে ৬ থেকে ৮ টাকা পর্যন্ত বৃদ্ধি পেয়েছে। পাশাপাশি মোটা ও মাঝারি চালের দামও বেড়েছে ২ থেকে ৩ টাকা পর্যন্ত। এর ফলে মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষজন পড়েছেন বাড়তি চাপের মুখে।

মূল কারণ: ধানের মূল্যবৃদ্ধি

চাল ব্যবসায়ীরা বলছেন, সম্প্রতি বোরো মৌসুমের ধান বাজারে এলেও উৎপাদনস্থলগুলোতে ধানের দাম হঠাৎ করে বেড়ে গেছে। ফলে চালকল মালিকরা বাড়তি দামে চাল সরবরাহ করছেন বাজারে। এর প্রভাব সরাসরি পড়ছে খুচরা বাজারে।

নওগাঁ, রাজশাহী, কুড়িগ্রাম, সিরাজগঞ্জ ও জয়পুরহাটের মতো বড় ধান উৎপাদন এলাকাগুলো থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, জনপ্রিয় ধান জাত যেমন জিরাশাইল ও কাটারিভোগের দাম গত এক সপ্তাহে মণপ্রতি ১৫০–২০০ টাকা পর্যন্ত বেড়েছে। এতে করে চালকলগুলোতে উৎপাদন ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় খুচরা বাজারেও চালের দাম বাড়ানো হয়েছে।

নওগাঁ চালকল মালিক গ্রুপের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ হোসেন চকদার জানান, “গত সপ্তাহে জিরাশাইল ও কাটারিভোগ ধানের দামে অস্বাভাবিক উত্থান হয়েছে। এতে পাইকারি চালের বাজারেও কেজিতে ২–৩ টাকা বেড়েছে, যার প্রভাব খুচরা বাজারে আরও বেশি।”

মিনিকেট চালের দাম এখন মধ্যবিত্তের নাগালের বাইরে

রাজধানীর মোহাম্মদপুর, মিরপুর, আগারগাঁও, টাউনহল বাজারসহ বিভিন্ন বাজার ঘুরে দেখা গেছে, মিনিকেট চালের দাম এক সপ্তাহ আগেও ছিল ৭৫–৭৬ টাকা, সেখানে এখন তা ৮০–৮২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। কিছু ব্র্যান্ড যেমন মোজাম্মেল মিনিকেটের দাম ৮৮–৯০ টাকা পর্যন্ত উঠেছে, ফলে অনেক দোকানদার এই চাল বিক্রি বন্ধ করে দিয়েছেন।

মিনিকেট চালের বর্তমান দাম (২০ জুন ২০২৫):

  • ডায়মন্ড / মঞ্জুর / সাগর / রশিদ ব্র্যান্ড: ৮০–৮২ টাকা কেজি
  • মোজাম্মেল মিনিকেট: ৮৮–৯০ টাকা কেজি

অধিকাংশ মধ্যবিত্ত পরিবার সাধারণত মিনিকেট চালেই ভাত রান্না করে থাকেন। এই মূল্যবৃদ্ধি তাই সরাসরি প্রভাব ফেলেছে তাদের দৈনন্দিন খরচে।

মোটা ও মাঝারি চালেও প্রভাব

যারা মোটা ও মাঝারি দামের চাল খেয়ে থাকেন, তাদের জন্যও সুখবর নেই। স্বর্ণা চালের দাম বেড়ে এখন ৫৭–৫৮ টাকা কেজি হয়েছে, যা আগে ছিল ৫৪–৫৫ টাকা। ব্রি-২৮ ও ব্রি-২৯ জাতের মাঝারি চালের দামও কেজিতে ২ টাকা বাড়িয়ে ৬০–৬২ টাকা পর্যন্ত উঠেছে।

এই চালগুলো সাধারণত নিম্ন আয়ের মানুষ বেশি ব্যবহার করেন। সুতরাং চালের দাম বৃদ্ধির প্রভাব সমাজের সর্বস্তরে পড়েছে।

ভোক্তাদের হতাশা ও ক্ষোভ

রাজধানীর মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে কথা হয় আদাবর এলাকার গৃহিণী আফসানা রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন,

“ঈদের পরপরই তো ধান উঠল, এখন চালের দাম বাড়ার তো কারণ থাকার কথা না। আগে ৭৬ টাকায় মিনিকেট কিনতাম, এখন ৮২ টাকা দিচ্ছি! মাসে একেকটা জিনিসের দাম বাড়ে, চলতে বড় কষ্ট হয়।”

সোনালি মুরগি ও আলুর দামও ঊর্ধ্বমুখী

চালের পাশাপাশি আরও কয়েকটি নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বাড়ছে। বিশেষ করে সোনালি মুরগির দাম প্রতি কেজিতে ৩০–৪০ টাকা বেড়ে এখন ২৮০–৩২০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। যদিও ব্রয়লার মুরগির দাম কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে—১৫০–১৬০ টাকায়।

ডিমের দামও এখন বেড়েছে। প্রতি ডজন ডিম বিক্রি হচ্ছে ১২০–১৩০ টাকায়।

আলুর দামও বেড়েছে কেজিতে ৫ টাকা। আগের দাম ২০–২৫ টাকা থাকলেও এখন ২৫–৩০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

পেঁয়াজ ও সবজি: আপাত স্বস্তি

পেঁয়াজের দাম এখনও সহনীয় পর্যায়ে রয়েছে। রাজধানীর বাজারে কেজি প্রতি ৫৫–৬০ টাকায় পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে। অন্যান্য সবজি যেমন করলা, লাউ, ঢেঁড়স, পটল, ঝিঙে— এসবের দাম আপাতত স্থিতিশীল আছে। ফলে সবজিতে কিছুটা স্বস্তি থাকলেও, প্রধান খাদ্যপণ্য চাল ও প্রোটিনের উৎস মুরগির দামে বাড়তি চাপ জনজীবনে প্রভাব ফেলছে।

বিশ্লেষণ: বারবার বাড়তি দাম কেন?

বিশেষজ্ঞদের মতে, ধান উৎপাদন থেকে চালের বাজার পর্যন্ত একটি অসংগঠিত ও অনিয়ন্ত্রিত সরবরাহ ব্যবস্থা রয়েছে। এর মধ্যে:

  • বাজার মনিটরিংয়ের অভাব
  • মজুতদারদের অনিয়ন্ত্রিত দখল
  • স্থানীয় পর্যায়ের সিন্ডিকেট
  • হঠাৎ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা

এসব কারণে দাম বাড়িয়ে ফেলার সুযোগ তৈরি হয়।

কী করা উচিত? সমাধানে যেভাবে এগোতে পারে সরকার

চালের বাজারে স্থিতিশীলতা আনতে নিচের কয়েকটি পদক্ষেপ কার্যকর হতে পারে:

  1. সরাসরি কৃষকের কাছ থেকে ধান সংগ্রহ করে সরকারি গুদাম পূর্ণ রাখা।
  2. বাজারে মোবাইল কোর্টের সংখ্যা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধি।
  3. সাবসিডি দিয়ে খুচরা বাজারে ওএমএস (ওপেন মার্কেট সেল) চালু রাখা।
  4. সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে কঠোর আইন প্রয়োগ।
  5. দাম নির্ধারণে কৃষি মন্ত্রণালয় ও ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের যৌথ তদারকি।

চাল বাংলাদেশের প্রধান খাদ্যপণ্য। এর দাম যদি বারবার বাড়ে, তাহলে তা দেশের নিম্ন ও মধ্যবিত্ত জনগণের জন্য বড় ধাক্কা হয়ে দাঁড়ায়। ঈদের পরপরই বাজারে এমন মূল্যবৃদ্ধি মানুষের আর্থিক সঙ্কটকে আরও গভীর করে তুলছে। এখন প্রয়োজন, সময়োপযোগী পদক্ষেপ ও বাজার নিয়ন্ত্রণে কার্যকর হস্তক্ষেপ।

মন্তব্য করুন
Advertisement

Related Articles

Advertisement
Back to top button