৩২ শতাংশ নাগরিকের ঘুষ দিতে হয়, সর্বোচ্চ দুর্নীতি বিআরটিএতে

বিবিএস-এর জরিপে অংশ নেয়া প্রায় ৮৫ হাজার নাগরিকের অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, সরকারি দপ্তরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঘুষ ও দুর্নীতি দেখা গেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) কার্যালয়ে। এখানে সেবা নিতে যাওয়া ৬৩ দশমিক ২৯ শতাংশ লোক ঘুষ দিতে বাধ্য হয়েছেন।
এছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোতেও দুর্নীতির হার অত্যন্ত বেশি, ৬২ দশমিক ৯৪ শতাংশ। পাসপোর্ট অফিসে ঘুষ দেওয়া বা দুর্নীতির শিকার হওয়ার হার ৫৭ দশমিক ৪৫ শতাংশ এবং ভূমি নিবন্ধন অফিসে ৫৪ দশমিক ৯২ শতাংশ। এই তথ্যগুলো থেকে স্পষ্ট যে, দেশের নাগরিকদের জীবনের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রে দুর্নীতির প্রবণতা খুবই উদ্বেগজনক মাত্রায় রয়েছে।
কেন এত বেশি দুর্নীতি?
বিআরটিএ ও অন্যান্য সরকারি দপ্তরে ঘুষের হার বেশি হওয়ার পিছনে রয়েছে কিছু কারণ। এসব দপ্তরের সেবা গ্রহণ প্রক্রিয়া জটিল, সময়সাপেক্ষ এবং অনেক ক্ষেত্রে সরকারি কর্মচারীদের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত কাগজপত্র বা অনিচ্ছাকৃত বিলম্ব হয়। এতে করে সাধারণ মানুষকে দ্রুত সেবা পেতে ঘুষ দেওয়া ছাড়া উপায় থাকে না বলে ধারণা করেন অনেকে।
এছাড়া, দুর্নীতি রোধে কার্যকর নজরদারি ও কঠোর শাস্তির অভাবও দুর্নীতির প্রবণতাকে বৃদ্ধি করে।
নিরাপত্তা অনুভূতিতে নারীর নিরাপত্তাহীনত
জরিপে নিরাপত্তা বিষয়েও উদ্বেগজনক তথ্য উঠে এসেছে। সন্ধ্যার পর নিজের এলাকায় একা চলাফেরা করতে ৮৪ দশমিক ৮১ শতাংশ নাগরিক নিরাপদ বোধ করেন। তবে পুরুষদের তুলনায় নারীরা নিরাপত্তাহীনতা অনুভব করেন বেশি। প্রতি পাঁচজন নারীর মধ্যে একজন সন্ধ্যায় একা চলাফেরা করতে নিরাপদ বোধ করেন না। পুরুষদের মধ্যে নিরাপত্তাবোধ রয়েছে ৮৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ।
নারীদের নিরাপত্তাহীনতার এই চিত্র সামাজিক প্রেক্ষাপটে নারী ও পুরুষের মধ্যে বর্ণনা করে যে, এখনও নারীদের নিরাপদ চলাচল এবং স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়ার প্রয়োজন রয়েছে।
রাজনৈতিক অংশগ্রহণ ও মত প্রকাশের সুযোগ
সরকার ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় মত প্রকাশ করার ক্ষেত্রে জনগণের আত্মবিশ্বাসও সীমিত। মাত্র ২৭ দশমিক ২৪ শতাংশ মানুষ মনে করেন তারা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় সরকারের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে মতামত প্রকাশ করতে পারেন। অর্থাৎ দেশের প্রায় তিন চতুর্থাংশ মানুষ নিজের মতামত প্রকাশ করতে অনাগ্রহী বা অনুৎসাহিত বোধ করেন।
এটি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার জন্য উদ্বেগজনক দিক, কারণ মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও অংশগ্রহণই হচ্ছে গণতন্ত্রের মেরুদণ্ড।
বৈষম্য ও হয়রানির শিকার
জরিপ অনুসারে, গত এক বছরে দেশের প্রায় ১৯ দশমিক ৩১ শতাংশ মানুষ কোনো না কোনো ধরনের বৈষম্য বা হয়রানির শিকার হয়েছেন। নারীরা এই ক্ষেত্রে পুরুষদের চেয়ে বেশি সমস্যায় পড়েছেন। এটি সামাজিক অসাম্য এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ইঙ্গিত বহন করে।
বৈষম্য ও হয়রানির এই চিত্র মোকাবিলায় সুশাসন ও ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি।
ঘুষ-দুর্নীতি রোধে করণীয়
সরকার ও সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর উচিত দুর্নীতি নির্মূলে কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করা। এর মধ্যে রয়েছে:
- স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা, যেখানে নাগরিকরা সহজে ও দ্রুত সেবা পাবেন।
- ডিজিটাল সেবা সম্প্রসারণ, যাতে দপ্তরগুলোর সরাসরি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কমে এবং দুর্নীতি কমে।
- দুর্নীতি বিরোধী প্রচারণা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা।
- দুর্নীতি করার দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দিয়ে অন্যদের সতর্ক করা।
নারীর নিরাপত্তা ও সমতা নিশ্চিতকরণ
নারীদের নিরাপত্তা বৃদ্ধির জন্য সামাজিক সচেতনতা, আইন প্রয়োগে কঠোরতা এবং নারী সুরক্ষা নীতি বাস্তবায়ন অপরিহার্য। এছাড়া, নারীদের জন্য নিরাপদ পরিবহন ব্যবস্থা, রাস্তাঘাটে পর্যাপ্ত আলো, নিরাপত্তা ক্যামেরা স্থাপন এবং দ্রুত সাড়া দেওয়ার ব্যবস্থা করা উচিত।
সার্বিক মন্তব্য
বাংলাদেশে সরকারি সেবায় দুর্নীতি, নিরাপত্তাহীনতা ও বৈষম্য এখনো বড় চ্যালেঞ্জ। গত এক বছরে দেশের নাগরিকদের অভিজ্ঞতা ও জরিপের ফলাফল স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে যে, সরকার ও সমাজকে একযোগে দুর্নীতি রোধ, নিরাপত্তা বৃদ্ধি ও মানবাধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কাজ করতে হবে।
সরকারি সেবা গ্রহণের ক্ষেত্রে নাগরিকদের ঘুষ দেওয়ার চাপ কমানো, নারীদের নিরাপদ চলাচল নিশ্চিত করা এবং রাজনৈতিক অংশগ্রহণ বৃদ্ধির মাধ্যমে দেশের গণতন্ত্রকে আরও শক্তিশালী ও সমৃদ্ধ করা সম্ভব।