অর্থনীতি

বিদেশে শ্রমবাজার সম্প্রসারণে নতুন উপদেষ্টা কমিটি

দেশের বিদেশে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও প্রবাসীদের সুরক্ষিত কর্মপরিবেশ নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে নতুন একটি উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ গতকাল রোববার এক প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে ‘বাংলাদেশিদের বিদেশে নিয়োগ-সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটি’ গঠন ঘোষণা করেছে। এই নতুন কমিটি ১১ সদস্যের, যারা প্রবাসী কর্মসংস্থানসহ মোট ৯টি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় নিয়ে সরকারের কাছে সুপারিশ প্রদান করবে। আগের কমিটি ছিল ১৩ সদস্যের, তবে বর্তমান কমিটি ছোট হলেও দক্ষ ও অভিজ্ঞ সদস্যরা নিয়ে গঠিত।

নতুন উপদেষ্টা কমিটির সদস্যবৃন্দ ও দায়িত্ব

নতুন উপদেষ্টা কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে দায়িত্ব পেয়েছেন প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ নজরুল। অন্যান্য সদস্যরা হলেন—

  • অর্থ উপদেষ্টা: সালেহউদ্দিন আহমেদ
  • পররাষ্ট্র উপদেষ্টা: মো. তৌহিদ হোসেন
  • স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা: লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী
  • শিল্প উপদেষ্টা: আদিলুর রহমান খান
  • শিক্ষা উপদেষ্টা: চৌধুরী রফিকুল আবরার
  • স্থানীয় সরকার উপদেষ্টা: আসিফ মাহমুদ সজীব ভুঁইয়া
  • শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম সাখাওয়াত হোসেন
  • সমাজকল্যাণ উপদেষ্টা: শারমীন এস মুরশিদ
  • বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন উপদেষ্টা: শেখ বশিরউদ্দীন
  • সংস্কৃতি বিষয়ক উপদেষ্টা: মোস্তফা সরয়ার ফারুকী

এই কমিটির সহায়ক কর্মকর্তা হিসেবে থাকবেন মন্ত্রিপরিষদ সচিব, প্রধান উপদেষ্টার মুখ্য সচিব, অর্থ সচিবসহ ১৬ জন সচিব এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর। প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় এই কমিটিকে সচিবীয় সহায়তা প্রদান করবে।

কমিটির কাজের ক্ষেত্র ও গুরুত্ব

নতুন উপদেষ্টা কমিটির মূল কাজ হচ্ছে—

  • বিদেশে জনশক্তি নিয়োগের সমন্বয় ও তদারকি
  • বৈদেশিক শ্রমবাজার সম্প্রসারণের পরিকল্পনা ও নতুন বাজার অনুসন্ধান
  • প্রবাসী কর্মীদের কল্যাণমূলক বিষয় সমাধান
  • অভিবাসী কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন
  • বৈধ পথে প্রবাসী আয় দেশে পাঠানোর ব্যবস্থাপনা
  • বৈদেশিক কর্মসংস্থান সংক্রান্ত বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা

এছাড়াও, কমিটি প্রয়োজন অনুসারে বৈঠক করে অতিরিক্ত সদস্য যুক্ত করতে পারবে।

বিদেশে কর্মসংস্থানের বর্তমান পরিস্থিতি ও চ্যালেঞ্জ

বাংলাদেশি শ্রমিকদের বিদেশে কর্মসংস্থানের তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণে বাংলাদেশ জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) জানিয়েছে যে ২০২৩ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে প্রবাসী কর্মীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ কমে গেছে। এর প্রধান কারণ মালয়েশিয়া, সংযুক্ত আরব আমিরাত ও ওমানের শ্রমবাজার বন্ধ হয়ে যাওয়া। বর্তমানে সৌদি আরব ছাড়া বড় কোনো শ্রমবাজার সক্রিয় নয়।

বিএমইটির পরিসংখ্যান অনুযায়ী—

  • ২০২১ সালে প্রবাসে গিয়েছেন ৬ লাখ ১৭ হাজার কর্মী
  • ২০২২ সালে সংখ্যা বৃদ্ধি পেয়ে ১১ লাখের বেশি
  • ২০২৩ সালে ১৩ লাখের বেশি
  • ২০২৪ সালে আবার কমে ১০ লাখ কর্মী

এই ১০ লাখের মধ্যে ৯০% শ্রমিক গেছেন মাত্র পাঁচটি দেশে—সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, কাতার, সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাত। মালয়েশিয়ার বাজার ২০২৪ সালের জুন থেকে বন্ধ। ওমানে ২০২৩ সালে প্রায় সোয়া লাখ কর্মী গিয়েছিলেন, ২০২৪ সালে মাত্র ৩৫৮ জন গিয়েছেন। সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২০২৩ সালে ১ লাখের মতো শ্রমিক গিয়েছিলেন, ২০২৪ সালে তা কমে ৪৭ হাজারের নিচে।

প্রবাসী কর্মীদের জন্য ভবিষ্যতের পরিকল্পনা

সরকারিভাবে ১৬৮টি দেশে কর্মী পাঠানোর লক্ষ্য থাকা সত্ত্বেও ২০২৪ সালে মাত্র ১৩৫টি দেশে কর্মী গেছেন। তবে অনেক দেশে শ্রমিক সংখ্যা অতি কম, যেমন ১৪টি দেশে একজন করে, আর ১৪টি দেশে দুজন করে। মাত্র ৮টি দেশে শ্রমিক সংখ্যা ১০ হাজারের ওপরে। শুধুমাত্র সৌদি আরবেই লাখের বেশি কর্মী গেছেন।

এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় নতুন উপদেষ্টা কমিটি বিভিন্ন পদক্ষেপের সুপারিশ করবে, যার মধ্যে রয়েছে—

  • নতুন শ্রমবাজার অন্বেষণ ও বিস্তৃতি
  • প্রবাসী কর্মীদের দক্ষতা উন্নয়ন ও প্রশিক্ষণ বৃদ্ধির মাধ্যমে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় সক্ষমতা অর্জন
  • প্রবাসী আয়ের বৈধ ও নিরাপদ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ
  • প্রবাসীদের সামাজিক, আইনি ও স্বাস্থ্য সুরক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ

নিয়োগ শব্দ সংক্রান্ত সংশোধনী

নতুন কমিটির নামকরণ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে ‘নিয়োগ’ শব্দটি কেন রাখা হয়েছে? মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা জানান, আদর্শ হলে ‘নিয়োগের’ পরিবর্তে ‘কর্মসংস্থানের সুযোগ’ শব্দটি ব্যবহার করা উচিত ছিল। কিন্তু পূর্ববর্তী প্রজ্ঞাপন থেকে প্রায় সবকিছুই অপরিবর্তিত রেখে শুধুমাত্র সদস্যদের নাম পরিবর্তন করায় নামকরণে এ রকম হয়েছে।

বর্তমান বিশ্বায়িত পরিপ্রেক্ষিতে প্রবাসী শ্রমিকদের সুরক্ষা, দক্ষতা উন্নয়ন ও কর্মসংস্থান বৃদ্ধির জন্য সরকারের এই উদ্যোগ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নতুন উপদেষ্টা কমিটির সুপারিশ বাস্তবায়ন হলে বাংলাদেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাতে গুণগত পরিবর্তন আশা করা যায়। প্রবাসী শ্রমিকরা দেশের অর্থনীতির একটি গুরুত্বপূর্ণ চালিকাশক্তি, তাদের কল্যাণ নিশ্চিত করা এবং নতুন শ্রমবাজার সৃষ্টি করা সময়ের দাবি।

এই নতুন কমিটি দেশের বৈদেশিক কর্মসংস্থানে নতুন দিগন্ত খুলে দেবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করছেন বিশেষজ্ঞরা। সঠিক দিকনির্দেশনা ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রবাসী কর্মীদের জীবনমান উন্নয়ন ও বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের পরিমাণ বাড়ানো সম্ভব হবে।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button