ইরান, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানির মধ্যে পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে নতুন আলোচনার ঘোষণা এসেছে। আগামী শুক্রবার তুরস্কের ইস্তানবুল শহরে অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে এই বৈঠক, যেখানে ইরানের কূটনীতিকরা ইউরোপের এই তিন প্রধান দেশের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসবেন।
ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যম এ তথ্য নিশ্চিত করেছে। এ সিদ্ধান্ত এসেছে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার মাত্র এক মাস পর, যা ইরানের পারমাণবিক স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্য করে পরিচালিত হয়েছিল।
ইরান-ইউরোপ আলোচনার পটভূমি
ইরান দীর্ঘদিন ধরেই পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে পশ্চিমা দেশগুলোর নজরদারির মধ্যে রয়েছে। যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি—যাদের একসঙ্গে “ই–থ্রি” নামে ডাকা হয়—তেহরানকে বারবার সতর্ক করে এসেছে, পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনায় না ফিরলে দেশটির ওপর আরও কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে।
ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইসমাইল বাঘাইক আজ সোমবার বলেছেন, ইউরোপীয় দেশগুলোর অনুরোধে তারা নতুন দফা আলোচনা শুরু করতে সম্মত হয়েছে। মূলত এই বৈঠকে ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।
ই–থ্রি এবং তাদের ভূমিকা
ই–থ্রি দেশগুলোর মধ্যে জার্মানির একটি কূটনৈতিক সূত্র এএফপিকে জানিয়েছে, তারা তেহরানের সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস, ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরিতে যেন কোনোভাবেই সুযোগ না দেওয়া হয়। এজন্য তারা টেকসই, যাচাইযোগ্য ও কূটনৈতিক সমাধানের জন্য নিবিড়ভাবে কাজ করে যাচ্ছে।
গত ২১ জুন সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ই–থ্রি এবং ইরানের প্রতিনিধিদের মধ্যে শেষ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছিল, যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হামলার ঠিক আগের দিন ছিল।
ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের হামলা: উত্তেজনার কারণ
২০২৫ সালের জুন মাসে ইসরায়েল ইরানের গুরুত্বপূর্ণ সামরিক ও পারমাণবিক স্থাপনাগুলোতে আকস্মিক হামলা চালায়। এরপর পাল্টাপাল্টি হামলার ঘটনা ঘটেছে, যার মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের হামলাও অন্তর্ভুক্ত। ইরানের কোম প্রদেশের ফর্দোতে অবস্থিত ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ কেন্দ্র, ইসফাহান ও নাতাঞ্জের পারমাণবিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্যবস্তু হয়।
এই সাম্প্রতিক উত্তেজনার আগে ওমানি মধ্যস্থতাকারীদের মাধ্যমে তেহরান ও ওয়াশিংটন বেশ কয়েক দফা আলোচনা চালিয়েছে, কিন্তু মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের নেতৃত্বে ইসরায়েলের সঙ্গে মিলে হামলা চালানোর সিদ্ধান্ত নেওয়ার ফলে ঐ আলোচনা বন্ধ হয়ে যায়।
রাশিয়ার ভূমিকা ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট
গতকাল রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন ক্রেমলিনে ইরানের সর্বোচ্চ নেতার পরমাণুবিষয়ক উপদেষ্টা আলী লারিজানির সঙ্গে অঘোষিত বৈঠক করেন। ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ জানিয়েছেন, বৈঠকে মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা ও ইরানের পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে আলোচনা হয়েছে।
পুতিন এও জানিয়েছেন, কিভাবে মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি শান্ত করা যায় এবং কূটনৈতিক মাধ্যমে ইরানের পরমাণু ইস্যুর সমাধান সম্ভব, সে বিষয়ে রাশিয়া তাদের অবস্থান প্রকাশ করেছে।
যদিও মস্কো তেহরানের ঘনিষ্ঠ মিত্র, তবুও ইসরায়েলকে সমর্থন দিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের হামলার পর রাশিয়া সরাসরি তেহরানের পক্ষে দাঁড়ায়নি, যা আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে একটি জটিলতা তৈরি করেছে।
২০১৫ সালের পারমাণবিক চুক্তি ও পরবর্তীতে এর পতন
২০১৫ সালে ইরান ও বিশ্ব শক্তিধর দেশগুলোর মধ্যে জয়েন্ট কমপ্রিহেনসিভ প্ল্যান অব অ্যাকশন (জেসিপিওএ) নামে একটি ঐতিহাসিক পারমাণবিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তির মাধ্যমে ইরানের পরমাণু কর্মসূচির ওপর কঠোর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয় এবং বিনিময়ে ইরানের ওপর থেকে কিছু নিষেধাজ্ঞা তুলে নেওয়া হয়।
কিন্তু ২০১৮ সালে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প আমেরিকাকে চুক্তি থেকে প্রত্যাহার করার সিদ্ধান্ত নেন। এরপর যুক্তরাষ্ট্র ইরানের ওপর নতুন নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে এবং চুক্তিটি কার্যত ভেঙে পড়ে। এই ঘটনায় মধ্যপ্রাচ্যে নতুন করে উত্তেজনা দেখা দেয়।
পরবর্তী পথ ও সম্ভাব্য সমাধান
বিশ্লেষকরা বলছেন, ইরান ও ইউরোপীয় দেশগুলোর এই নতুন আলোচনাটি আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। পারমাণবিক অস্ত্র তৈরি রোধ এবং নির্দিষ্ট সীমাবদ্ধতা আরোপে সফল হলে, মধ্যপ্রাচ্যের শান্তির জন্য বড় ধরনের অবদান রাখবে।
তবে, ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রাসন এবং রাজনৈতিক চাপ অনেক জটিলতা তৈরি করেছে। তাই কূটনৈতিক আলোচনার মাধ্যমে শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে পাওয়াই এখন একমাত্র পথ বলে মনে করা হচ্ছে।
সংক্ষিপ্ত বিবরণ
- ইরান, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স ও জার্মানি পরমাণু কর্মসূচি নিয়ে নতুন আলোচনা শুরু করতে যাচ্ছে।
- বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে ইস্তানবুল, তুরস্কে।
- এই আলোচনা হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইসরায়েলের সাম্প্রতিক হামলার এক মাস পর।
- ই–থ্রি নামে পরিচিত এই তিন দেশ ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র তৈরির অনুমতি দেবে না।
- রাশিয়া, মস্কোতে ইরানের উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেছে।
- ২০১৫ সালের জেসিপিওএ পারমাণবিক চুক্তি থেকে ২০১৮ সালে যুক্তরাষ্ট্র প্রত্যাহার করে।
- বর্তমানে পারমাণবিক কর্মসূচি নিয়ন্ত্রণ ও আন্তর্জাতিক চাপের মাঝে মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।



