এক বছরে দ্বিগুণ বেড়েছে ডলার ও বিদেশিদের ব্যাংকে আমানত

বাংলাদেশে ডলার ও বিদেশিদের আমানত দ্বিগুণ বৃদ্ধি, অর্থনীতিতে নতুন আশার সঙ্কেত
বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে বিদেশি মুদ্রায় আমানত রেকর্ড পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষ করে ডলারসহ বিভিন্ন বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত এক বছরে প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে, যা দেশের অর্থনীতির জন্য ইতিবাচক সংকেত। এর ফলে বিদেশিরা এবং দেশের নিজস্ব প্রবাসীরা ব্যাংকে বেশি করে বৈদেশিক মুদ্রায় অর্থ জমা রাখছেন। সাম্প্রতিক বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ত্রৈমাসিক প্রতিবেদনে প্রকাশিত তথ্য অনুসারে, গত এক বছরে ব্যাংকগুলোতে বিদেশি মুদ্রায় আমানত বেড়েছে অন্য সব আমানতের চেয়ে বেশি।
বিদেশি ও প্রবাসীদের আমানত কেন বেড়েছে?
বাংলাদেশে অর্থনৈতিক পরিবেশে পরিবর্তন এবং সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে বিদেশি মুদ্রায় আমানতের আকর্ষণ বৃদ্ধি পেয়েছে। বিশেষত ২০২৩ সালের ডিসেম্বর মাসে ডলার সংকটের পর বাংলাদেশ ব্যাংক রেসিডেন্ট ফরেন কারেন্সি ডিপোজিট (আরএফসিডি) অ্যাকাউন্টে সুদসহ বাড়তি সুবিধা প্রদান শুরু করে। এর ফলে ঘরে রাখা বিদেশি মুদ্রাগুলো আবার ব্যাংকে ফিরতে শুরু করেছে।
ব্যাংকগুলো ডলারসহ ইউরো, পাউন্ড, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, কানাডিয়ান ডলার, সিঙ্গাপুরি ডলার ইত্যাদি মুদ্রায় এই সুবিধা দিচ্ছে। এছাড়া, এই ধরনের হিসাব থেকে যেকোনো সময় দেশের বাইরে নগদ অর্থ ব্যয় করা যায় এবং বিদেশ ভ্রমণের সময় নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা সহজেই নেওয়া যায়।
বিদেশি মুদ্রায় আমানতের বিস্তারিত পরিসংখ্যান
- বিদেশিদের টাকায় রূপান্তরযোগ্য হিসাব (কনভার্টেবল টাকা অ্যাকাউন্ট অব ফরেনার্স)
২০২৪ সালের মার্চে এই হিসাবের স্থিতি ছিল ১,৮০৪ কোটি টাকা, যা ২০২৫ সালের মার্চে বেড়ে হয়েছে ৩,৮৫৯ কোটি টাকা। - বৈদেশিক মুদ্রার হিসাব (এফসিএ)
২০২৪ সালের মার্চে আমানত ছিল ৬,০৫৪ কোটি টাকার সমপরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা, যা ২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে বেড়ে হয়েছে ১৪,৭৫০ কোটি টাকা। - প্রবাসীদের আলাদা আমানত হিসাব
২০২৪ সালের মার্চে ছিল ৩,৪৭৭ কোটি টাকা, যা ২০২৫ সালের মার্চে বেড়ে ৪,৭৭৮ কোটি টাকা। - বৈদেশিক মুদ্রার আরএফসিডি হিসাব (বিদেশ সফর শেষে ফেরত আসা বাংলাদেশিদের জন্য)
২০২৪ সালের মার্চে ছিল ২৬,১৩০ কোটি টাকা, যা ২০২৫ সালের মার্চে বেড়ে হয়েছে ৩৩,২৭৩ কোটি টাকা।
সামগ্রিক আমানত বৃদ্ধি তুলনামূলকভাবে ধীরগতির
যদিও বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত খুব দ্রুত বেড়েছে, দেশের সামগ্রিক ব্যাংক আমানত ১.০৯% বেড়েছে। ২০২৪ সালের মার্চে মোট আমানত ছিল ১৭ লাখ ৬২ হাজার ৩০৩ কোটি টাকা, যা ২০২৫ সালের মার্চে বেড়ে হয়েছে ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৪ কোটি টাকা। অর্থাৎ, দেশীয় মুদ্রায় আমানত বৃদ্ধি ধীর গতিতে হলেও বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত দ্বিগুণেরও বেশি হয়েছে।
ব্যাংকগুলোর উদ্যোগ ও সুবিধাসমূহ
বাংলাদেশ ব্যাংকের উদ্যোগে বাড়তি সুদ ও সুবিধার কারণে ব্যাংকগুলো বিদেশি মুদ্রায় আমানত সংগ্রহে আগ্রহী হয়েছে। ইস্টার্ন ব্যাংক, দি সিটি ব্যাংক, ব্র্যাক ব্যাংক, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক, প্রাইম ব্যাংক, পূবালী ব্যাংক, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ও এইচএসবিসিসহ বিভিন্ন ব্যাংক এ সুবিধা দিচ্ছে।
ব্যাংক থেকে সরাসরি বিদেশ ভ্রমণ ও চিকিৎসা, শিক্ষাসহ অন্যান্য খাতে অর্থ ব্যয় করা যায়। আরএফসিডি অ্যাকাউন্ট থেকে দেশে বা বিদেশে নগদ ৫ হাজার মার্কিন ডলার পর্যন্ত নেওয়া সম্ভব। প্রবাসীদের জন্য সব ধরনের বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব খোলার সুযোগ দেওয়া হয়েছে, যার ফলে সুদের হারও বাজারভিত্তিক নির্ধারিত হয়।
প্রবাসী ও বিদেশিদের জন্য ব্যাংকিং খাতের ইতিবাচক প্রভাব
বেসরকারি মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, বিদেশি মুদ্রায় আমানত বেড়ে যাওয়ায় এটি অর্থনীতির জন্য খুবই ইতিবাচক। কারণ, অন্যান্য আমানতে প্রবৃদ্ধি ধীর হলেও ডলারে আমানত দ্বিগুণ হয়েছে। ব্যাংক থেকে সুদ পাওয়ায় এবং বিদেশি বিনিয়োগকারীদের আগমনে বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা দেশের মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ এবং বিনিময় হার স্থিতিশীল রাখতে সহায়তা করবে।
বাংলাদেশে বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত বৃদ্ধির প্রভাব ও ভবিষ্যৎ
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক দৃশ্যপটে বৈদেশিক মুদ্রায় আমানত বৃদ্ধি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ও বৈদেশিক মুদ্রার ঘাটতি কাটানোর ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকা রাখছে। বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রবাসী অর্থায়নের প্রবাহে এই পরিবর্তন দেশের রিজার্ভ বাড়াতে সাহায্য করছে।
সরকারের মুদ্রানীতি এবং ব্যাংকিং খাতের উদ্ভাবনী উদ্যোগের কারণে বৈদেশিক মুদ্রায় আমানতের আকর্ষণ বাড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে দেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির এক বড় চালিকা শক্তি হবে। বিশেষত, বৈদেশিক মুদ্রায় জমাকৃত অর্থের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সহজ হচ্ছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার ঝুঁকি হ্রাস পাচ্ছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বৈদেশিক মুদ্রার আমানত বৃদ্ধি একটি আশার বার্তা নিয়ে এসেছে। এতে বিদেশি বিনিয়োগ ও প্রবাসীদের অর্থ দেশীয় ব্যাংকিং খাতে প্রবাহিত হচ্ছে, যা অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং মুদ্রা বাজারের স্থিতিশীলতায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখবে। ব্যাংকিং খাতের এই ধারা আগামী দিনে আরও দৃঢ় হবে বলে আশা করা হচ্ছে।