তিন মাসে ব্যাংকে আমানত বেড়েছে ৪০ হাজার কোটি টাকা

চলতি বছরের প্রথম তিন মাসে (জানুয়ারি-মার্চ) দেশের ব্যাংক খাতে আমানত উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ হালনাগাদ পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এই সময়ের মধ্যে ব্যাংক আমানত বেড়েছে প্রায় ৩৯ হাজার ৭৯৫ কোটি টাকা, যা প্রবৃদ্ধির দিক থেকে ২ শতাংশের বেশি।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর শেষে ব্যাংকে আমানতের পরিমাণ ছিল ১৮ লাখ ৮৩ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। আর ২০২৫ সালের মার্চ শেষে তা দাঁড়িয়েছে ১৯ লাখ ২৩ হাজার ৫০৬ কোটি টাকায়।
শহর বনাম গ্রামীণ এলাকা: কোথায় কত আমানত?
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই তিন মাসে গ্রামীণ এলাকার আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৩ শতাংশের বেশি, যেখানে শহরাঞ্চলে তা ছিল ১.৯৪ শতাংশ। তবে মোট আমানতের বড় অংশই এখনো শহরাঞ্চলেই রয়েছে।
মার্চ ২০২৫ শেষে বিভাজন:
- শহরাঞ্চল: ১৬ লাখ ২২ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা (≈৮৪%)
- গ্রামাঞ্চল: ৩ লাখ ১ হাজার ৩৪৭ কোটি টাকা (≈১৬%)
সুদহার বাড়ছে, বাড়ছে আমানতও
তিন মাসে ব্যাংকে আমানতের প্রবৃদ্ধির পেছনে সুদহারের বৃদ্ধি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
- অক্টোবর–ডিসেম্বর প্রান্তিকে গড় সুদহার ছিল ৬.০৪%
- জানুয়ারি–মার্চে তা বেড়ে দাঁড়ায় প্রায় ৬.২৫%
সুদহার বৃদ্ধির ফলে আমানতকারীদের মধ্যে ব্যাংকে অর্থ জমা রাখার প্রবণতা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন খাত–সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
ব্যাংক খাতে আস্থা ফিরে আসার কারণ
ব্যাংক খাতের আমানত বৃদ্ধির পেছনে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিবর্তন ভূমিকা রেখেছে:
শাসনপট পরিবর্তন:
গত আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মাধ্যমে রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের পর এক ডজনের বেশি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠিত হয়। এগুলোর বড় অংশ নিয়ন্ত্রিত ছিল এস আলম গ্রুপের মাধ্যমে।
নতুন পর্ষদের উদ্যোগ:
নতুন পরিচালনা পর্ষদ সংকট কাটাতে আমানত সংগ্রহে আগ্রহী হয়ে পড়ে এবং সুদহার বাড়িয়ে আমানত সংগ্রহে তৎপর হয়।
আস্থা ফিরে আসছে:
আগের সরকার আমলে ব্যাংক খাতে অনিয়ম এবং ঋণ জালিয়াতির কারণে যেভাবে আস্থা নষ্ট হয়েছিল, নতুন পরিপ্রেক্ষিতে সেই আস্থা আস্তে আস্তে ফিরছে।
রেমিট্যান্সের প্রবৃদ্ধি:
ঢাকা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক শেখ মোহাম্মদ মারুফ বলেন,
“সাম্প্রতিক সময়ে প্রবাসী আয়ে ভালো প্রবৃদ্ধি হচ্ছে। বিদেশ থেকে আসা রেমিট্যান্সের বড় অংশই ব্যাংকে আমানত হিসেবে জমা হচ্ছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মানুষের আস্থাও বাড়ছে।”
ঋণ প্রবৃদ্ধিও উল্লেখযোগ্য
একই সময়ে, অর্থাৎ জানুয়ারি-মার্চ প্রান্তিকে ব্যাংক খাতে ঋণ বেড়েছে ২৯ হাজার ৭৪০ কোটি টাকা, যা ১.৭৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি।
মার্চ ২০২৫ শেষে মোট ঋণ:
→ ১৭ লাখ ১২ হাজার ৬১৮ কোটি টাকা
- শহরাঞ্চলে বিতরণ: ১৫ লাখ ৭৫ হাজার ৮৯৮ কোটি (৯২%)
- গ্রামাঞ্চলে বিতরণ: ১ লাখ ৩৬ হাজার ৭২১ কোটি (৮%)
অতীত থেকে শিক্ষা, সামনে সম্ভাবনা
গত কয়েক বছরে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বড় অঙ্কের ঋণ জালিয়াতি, তরলতার সংকট, এবং ব্যাংক গ্রাহকদের অনাস্থা ব্যাংক খাতকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
সেই পটপরিবর্তনের পর প্রশাসনিক সংস্কার, রেমিট্যান্স প্রবাহ, এবং সুদহার বৃদ্ধির সমন্বয়ে এখন ব্যাংক খাত নতুন করে ঘুরে দাঁড়াচ্ছে।
তিন মাসে প্রায় ৪০ হাজার কোটি টাকার আমানত বৃদ্ধি কেবল একটি সংখ্যাগত অগ্রগতি নয়, এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক ও অর্থনৈতিক আস্থার পুনরাবির্ভাব। পরবর্তী প্রান্তিকগুলোতে এই ধারা অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের ব্যাংক খাত দীর্ঘমেয়াদে আরও স্থিতিশীল ও স্বচ্ছ হতে পারে।