প্রস্তাবিত বাজেট জনবান্ধব-ব্যবসাবান্ধব : অর্থ উপদেষ্টা

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে আলোচনার ঝড় উঠেছে দেশজুড়ে। অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ এই বাজেটকে ‘জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব’ হিসেবে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেছেন, এই বাজেটে প্রবৃদ্ধি অর্জনের পাশাপাশি জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। মঙ্গলবার (৩ জুন) রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত বাজেটোত্তর সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসব কথা বলেন।
বাজেটের মূল লক্ষ্য: জনগণের স্বস্তি ও অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা
ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ জানান, এবারের বাজেটে জনগণের জীবনযাত্রাকে স্বচ্ছ ও সহজ করার ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, “অতীতে আমরা প্রবৃদ্ধি অর্জনের দিকে বেশি মনোযোগ দিয়েছি। কিন্তু সেই প্রবৃদ্ধি সমাজের সব স্তরের পর্যন্ত পৌঁছায়নি। এবার আমরা সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নের দিকে বিশেষ নজর দিয়েছি।” তিনি আরও উল্লেখ করেন, বাজেটের আকার এবার প্রথমবারের মতো কমানো হয়েছে, যা বাস্তবায়নের জন্য তুলনামূলকভাবে সহজ হবে।
অর্থ উপদেষ্টার মতে, বাজেটে অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় বেশ কিছু পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা এবং জ্বালানি খাতের সমস্যা সমাধানের জন্য নির্দিষ্ট পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, “এই সরকার একটি কঠিন সময়ে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে। আর্থিক খাত প্রায় খাদের কিনারায় পৌঁছে গিয়েছিল। তবে সম্মিলিত প্রচেষ্টার মাধ্যমে আমরা এই খাতকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে এসেছি।”
বাজেটে নতুনত্ব ও বাস্তবতা
অর্থ উপদেষ্টা স্বীকার করেছেন যে বাজেটে বিপ্লবী পরিবর্তন আনা সম্ভব হয়নি। তবে তিনি জোর দিয়ে বলেন, এতে নতুনত্বের অভাব নেই। তিনি বলেন, “অনেকে বলছেন, আমরা পুরনো পথেই হেঁটেছি। কিন্তু হুট করে বিপ্লবী বাজেট দেওয়া সম্ভব নয়। তবে আমরা বাস্তবভিত্তিক একটি বাজেট প্রণয়নের চেষ্টা করেছি। কথার ফুলঝুরি বাদ দিয়ে আমরা জনগণের জন্য বাস্তবসম্মত সমাধান নিয়ে এসেছি।”
বাজেটে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমানো এবং তাদের ক্রয়ক্ষমতা বাড়ানো। অর্থ উপদেষ্টা জানান, এই বাজেটে ব্যবসায়ীদের জন্যও সুবিধা রাখা হয়েছে। তবে তিনি সতর্ক করে বলেন, “একদিকে কর কমালে অন্যদিকে তা বাড়াতে হয়। তাই সম্পূর্ণ ব্যবসাবান্ধব বাজেট করা সম্ভব নয়। তবে আমরা জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব ভারসাম্যের চেষ্টা করেছি।”
আর্থিক খাতের সংকট ও সমাধানের পথ
অর্থ উপদেষ্টা আরও বলেন, বর্তমান সরকার যখন দায়িত্ব গ্রহণ করে, তখন দেশের আর্থিক খাত প্রায় ‘আইসিইউ’ অবস্থায় ছিল। তিনি বলেন, “আমরা সবাই মিলে এই খাতকে একটি স্থিতিশীল অবস্থায় নিয়ে এসেছি। মূল্যস্ফীতি কমানো সম্ভব হয়েছে, এবং জনগণের জন্য আরও স্বস্তি আনার চেষ্টা চলছে।”
বাজেটে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে। ড. সালেহউদ্দিন বলেন, “পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে সময় লাগবে। তবে এই অর্থ যদি ফেরত আনা যায়, তাহলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) কাছে হাত পাততে হতো না। দেশীয় সম্পদ বাড়লে এবং কর আদায় বৃদ্ধি পেলে আমাদের বাজেট সাপোর্টের জন্য দাতা সংস্থার ওপর নির্ভর করতে হতো না।”
আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের আস্থা
অর্থ উপদেষ্টা জানান, বিভিন্ন দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ধারণা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, “আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের প্রতি ভালো ধারণা পোষণ করছে। তবে দেশের গণমাধ্যমে সমালোচনা থাকবে, এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু শুধু সমালোচনা করলে আমাদের বারবার ব্যাখ্যা দিতে হয়।”
বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা ও উন্নয়ন
প্রস্তাবিত বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা খাতে বিশেষ বরাদ্দ রাখা হয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় কমাতে ভর্তুকি বাড়ানো হয়েছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং কৃষি খাতেও বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা বলেন, “আমরা চাই, প্রতিটি নাগরিক যেন এই বাজেটের সুফল পায়। আমাদের লক্ষ্য হচ্ছে, সাধারণ মানুষের জীবনে স্বস্তি আনা।”
ব্যাংকিং খাতে সংস্কারের জন্যও বাজেটে বিশেষ পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর জানান, ব্যাংকিং খাতে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে নতুন নীতিমালা প্রণয়ন করা হচ্ছে। এছাড়া, পুঁজিবাজারের স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে।
বাজেট বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ
অর্থ উপদেষ্টা স্বীকার করেছেন, বাজেট বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে। তিনি বলেন, “বাজেটের আকার কম হলেও এর বাস্তবায়ন কঠিন হবে না। তবে আমাদের সবাইকে একযোগে কাজ করতে হবে।” তিনি আরও জানান, সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে, বাজেটের প্রতিটি টাকা যেন সঠিকভাবে কাজে লাগে।
সংবাদ সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, সড়ক, সেতু ও রেলপথ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান, স্বরাষ্ট্র ও কৃষি উপদেষ্টা মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী, বাণিজ্য, বিমান, বস্ত্র ও পাট উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দীন, কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ড. আহসান এইচ মনসুর, মন্ত্রিপরিষদ সচিব শেখ আব্দুর রশীদ এবং এনবিআর চেয়ারম্যান মো. আবদুর রহমান খান।
উপসংহার
২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেট জনবান্ধব ও ব্যবসাবান্ধব ভারসাম্য রক্ষার চেষ্টা করেছে। অর্থ উপদেষ্টার মতে, এই বাজেট দেশের অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনতে এবং জনগণের জীবনযাত্রার মান উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। তবে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনা, কর আদায় বৃদ্ধি এবং আর্থিক খাতের সংস্কারের মতো চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সরকারকে আরও কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে।