অর্থনীতি

নতুন বাজেটে শুল্ক বৃদ্ধিতে রড-সিমেন্টের দাম বাড়বে, চাপে সাধারণ নির্মাণ খাত

২০২৫-২৬ অর্থবছরের প্রস্তাবিত জাতীয় বাজেটে রড ও সিমেন্টের কাঁচামালে শুল্ক ও কর বৃদ্ধির প্রস্তাবে সাধারণ নির্মাণ ব্যয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা। সিমেন্টের মূল কাঁচামাল ক্লিংকার এবং রড তৈরির উপকরণ যেমন স্ক্র্যাপ লোহা, স্পঞ্জ আয়রন ও পিগ আয়রনের উপর শুল্ক হার পরিবর্তনের প্রেক্ষিতে বাজারে এই দুই নির্মাণ উপকরণের দাম বাড়তে পারে

চট্টগ্রামের একাধিক শিল্পপ্রতিষ্ঠান, আমদানিকারক ও উৎপাদক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নতুন শুল্ক কাঠামোর ফলে প্রতি টনে রড উৎপাদনে খরচ বাড়বে গড়ে ৯০০ টাকা এবং সিমেন্ট উৎপাদনে খরচ বাড়বে ৪০০ টাকার বেশি। এর প্রভাব সরাসরি পড়বে সাধারণ ক্রেতাদের ওপর।

ক্লিংকার আমদানিতে শুল্ক বৃদ্ধি: সিমেন্টে মূল্যবৃদ্ধির ইঙ্গিত

প্রস্তাবিত বাজেটে সিমেন্টের অন্যতম প্রধান কাঁচামাল ক্লিংকার আমদানিতে নির্দিষ্ট শুল্ক বাতিল করে মূল্যের ভিত্তিতে শতাংশ হারে শুল্ক নির্ধারণ করা হয়েছে। আগে প্রতি টনে নির্ধারিত ৭০০ টাকা কাস্টমস শুল্ক নেওয়া হতো, এখন থেকে এই হার পরিবর্তন করে শিল্পকারখানা থাকলে ১৫% এবং না থাকলে ২৫% হারে শুল্ক দিতে হবে।

সিমেন্ট শিল্প সংশ্লিষ্ট এক উদ্যোক্তা প্রথম আলোকে বলেন, নতুন শুল্ক হার অনুযায়ী ক্লিংকার আমদানিতে প্রতি টনে অতিরিক্ত ৪৩৭ টাকা খরচ হবে। এর ফলে বাজারে প্রতি বস্তা সিমেন্টের দাম ৯-১০ টাকা পর্যন্ত বাড়তে পারে।

বাংলাদেশে বার্ষিক গড়ে ২ কোটি টনের বেশি ক্লিংকার আমদানি হয়ে থাকে। এই হিসাবে শুধু এই খাত থেকেই সরকারের অতিরিক্ত রাজস্ব আদায় হতে পারে ৮০০ কোটি টাকারও বেশি। তবে এই অর্থ শেষ পর্যন্ত বহন করবে দেশের সাধারণ ভোক্তা, কারণ উৎপাদন ব্যয় বাড়লে পণ্য মূল্যও বাড়বে।

রডের কাঁচামালেও কর বৃদ্ধি: প্রতিটি স্তরেই চাপ

সিমেন্টের পাশাপাশি রড তৈরির কাঁচামালের ক্ষেত্রেও শুল্ক ও কর বাড়ানো হয়েছে। স্ক্র্যাপ লোহা, স্পঞ্জ আয়রন এবং পিগ আয়রনের আমদানিতে নতুন করে কর আরোপ এবং বিদ্যমান শুল্ক পুনর্নির্ধারণ করা হয়েছে।

  • স্ক্র্যাপ লোহা: আগে প্রতি টনে শুল্ক ছিল ২০০০ টাকা, যা এবার বাড়িয়ে ২৪০০ টাকা করা হয়েছে।
  • স্পঞ্জ ও পিগ আয়রন: প্রতি টনে ৩০০ টাকা করে অতিরিক্ত শুল্ক আরোপ করা হয়েছে।

গত অর্থবছরে রড তৈরির এসব কাঁচামালের আমদানি হয়েছে প্রায় ৬৪ লাখ ৮১ হাজার টন, যার বিপরীতে সরকার রাজস্ব পেয়েছে ১ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা। নতুন শুল্ক কাঠামো অনুযায়ী এবার এই খাতে সরকারের রাজস্ব আদায় কমপক্ষে ২০০ কোটি টাকা বেশি হতে পারে।

উৎপাদন পর্যায়েও ভ্যাট বাড়লো

আমদানির পাশাপাশি দেশীয় উৎপাদন পর্যায়েও করের বোঝা বাড়ানো হয়েছে। আগে রড তৈরির জন্য পুরোনো লোহা গলিয়ে বিলেট এবং সেখান থেকে রড উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় প্রতি টনে ২২০০ টাকা ভ্যাট (মূল্য সংযোজন কর) আরোপ করা হতো। নতুন বাজেটে এই হার বাড়িয়ে ২৭০০ টাকা করা হয়েছে।

মোস্তফা হাকিম গ্রুপের পরিচালক সারোয়ার আলম বলেন, “আমদানিকৃত কাঁচামাল এবং স্থানীয় উৎপাদন উভয় পর্যায়ে শুল্ক ও করের সম্মিলিত প্রভাবে এখন প্রতি টনে রডে মোট শুল্ক-কর দাঁড়াবে ৫১০০ টাকা, যা আগে ছিল ৪২০০ টাকা। এতে প্রতি টনে রড উৎপাদনে ৯০০ টাকা খরচ বেড়ে যাচ্ছে।”

তিনি আরও জানান, যেসব প্রতিষ্ঠান স্ক্র্যাপ লোহা গলিয়ে নিজেরাই বিলেট তৈরি করে আবার সেখান থেকে রড তৈরি করে, তাদের জন্য এই খরচ আরও বেশি হবে। ফলে বাজারে রডের দাম দ্রুত বাড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

নির্মাণ খাতে চাপ বাড়ছে, উদ্বেগে সাধারণ মানুষ ও ডেভেলপাররা

নির্মাণ খাতে এই মূল্যবৃদ্ধির আশঙ্কায় উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে আবাসন ডেভেলপাররাও। কারণ, রড ও সিমেন্ট—এই দুটি উপকরণই আবাসন, সেতু, রাস্তাঘাট, বাণিজ্যিক ভবন নির্মাণসহ সকল অবকাঠামোগত উন্নয়ন কাজের জন্য অপরিহার্য।

বাংলাদেশ রিয়েল এস্টেট ডেভেলপার্স অ্যাসোসিয়েশন (রেডা) জানিয়েছে, গত দুই বছর ধরে ডলারের দাম বৃদ্ধি, ব্যাংক সুদের হার বৃদ্ধি এবং নির্মাণ উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে আবাসন খাত আগেই চাপে ছিল। নতুন এই শুল্ক পরিবর্তনের ফলে দামে আরেক দফা ঝাঁকুনি আসবে, যা ক্রেতা-বিক্রেতা উভয়ের জন্যই চাপের।

বিশেষজ্ঞদের মতামত ও পরামর্শ

নির্মাণ খাতের বিশ্লেষকরা মনে করছেন, বাজেটের মাধ্যমে সরকার রাজস্ব আয় বাড়াতে চাইলেও এর প্রভাব সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায় নেতিবাচক প্রভাব ফেলতে পারে। কারণ, দেশে গৃহনির্মাণ, স্কুল, হাসপাতাল ও রাস্তা নির্মাণের মতো কাজগুলোতে রড ও সিমেন্টের ব্যবহার অপরিহার্য।

অর্থনীতিবিদদের একাংশ পরামর্শ দিচ্ছেন, বাজেট ঘোষণার পরপরই সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করে নীতিনির্ধারণে নমনীয়তা দেখানো উচিত। প্রয়োজন হলে নির্দিষ্ট কাঁচামালের উপর শুল্ক কমিয়ে জনগণের ওপর চাপ কমানো যেতে পারে।

২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে রড ও সিমেন্টের উপর শুল্ক ও কর বৃদ্ধির ফলে বাংলাদেশের নির্মাণ খাতে খরচ বাড়বে, যা একদিকে সরকারকে অতিরিক্ত রাজস্ব এনে দিলেও অন্যদিকে জনগণের কাঁধে বাড়তি বোঝা চাপাবে। এমন সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সরকারের উচিত হবে সব পক্ষের মতামত বিবেচনা করে ভারসাম্যপূর্ণ নীতিমালা গ্রহণ করা।

মন্তব্য করুন

Related Articles

Back to top button